শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়া প্রসঙ্গে ছাত্রসমাজ : প্রশ্ন শুধু সেকুলার কিংবা ধর্মীয় নয় ।

--------------- জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরির নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছিল গত ৬ এপ্রিল। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর এ শিক্ষানীতি দেশের ১০ম শিক্ষানীতি/শিক্ষাকমিশন রিপোর্ট হিসেবে প্রকাশ হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষা নীতি কমিটি গত ৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী বরাবর তাদের রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের ওয়েবসাইট www.moedu.gov.bd -তে সবার জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে খসড়া প্রতিবেদনটি সর্ম্পকে ই-মেইলে মতামত পাঠাতে আহবান করেছে সরকার। এ পর্যন্ত কারা কারা কেমনতরো মত-অমত জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রনালয়কে সে বিষয়ে জানা যায়নি। তবে নানা প্লাটফর্মে সংঘবদ্ধ ছাত্রছাত্রীরা তাদের মতামত জানিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। ------------- ছাত্রলীগ শিক্ষানীতির খসড়াকে নি:শর্তভাবে স্বাগত জানিয়েছে। সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি সভা-সমাবেশের মাধ্যমে দাবি জানিয়েছে অতি দ্রুত খসড়াটিকে চুড়ান্ত করার জন্য। ঠিক এর উল্টো অবস্থান নিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তারা খসড়া প্রতিবেদনটিকে পুরোপুরি প্রত্যাখান করেছে এবং ছাত্রলীগের তুলনায় দেরিতে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমাবেশ করে সরকারের কাছে এটি প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ এখন সরকারে আছে সুতরাং দলটির সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে জনমত গড়তে শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো প্রচারনা চালায়নি। ছাত্রদল এককথায় বলেছে ওই খসড়া প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের মূল্যবোধ বিরোধি, সুতরাং ছাত্রজনতাকে সাথে নিয়ে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। আজ পর্যন্ত এমন কোনো আলামত দেখা যায়নি যে দলটি ছাত্রজনতার সাথে এ বিষয়ে আলাপে আগ্রহী। বামপন্থী হিশাবে পরিচিত ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ ’র খসড়া প্রতিবেদন সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে বিস্তারিত মতামত পাঠিয়েছে। সংগঠনটি তাদের মতামত-এ মত-অমতের ওপর জোর দেয়ার চেয়ে প্রতিবেদনটির ভেতরকার স্ববিরোধিতা এবং সংবিধান ও সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তির সাথে প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত নীতির সংর্ঘষের জায়গা গুলো তুলে ধরতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তারা বলছে, খসড়া প্রতিবেদনে একদিকে একই ধারার শিক্ষা চালু করার সাংবিধানিক অঙ্গিকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অথচ একই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকেই বিভিন্ন ধারা চালু রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সবমিলিয়ে ‘‘প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রেখে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের সুপারিশ করা হয়েছে।’’ ছাত্রফ্রন্টের দাবি; ‘‘এতে বিরাজমান বৈষম্য দূর হবে না বরং বৈষম্যের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দৃঢ় করা হবে।’’ প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের যে সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়া নীতিতে তার বিরোধিতা করেছে তারা। এবারের শিক্ষানীতি যে প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি লোকপ্রিয় বিতর্ক জন্ম দিয়েছে সেই ধর্ম- নৈতিকতা-সেকুলারিজম প্রশ্নে সংগঠনটি বাংলাদেশে প্রচলিত বামপন্থী রাজনীতির অবস্থান থেকে মোটাদাগে ইসলাম বিরোধী, সুতরাং ধর্ম ও মাদ্রাসা বিরোধী কট্টর অবস্থান নিয়েছে সংগঠনটি। জঙ্গীবাদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দায়ী করে তাকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের পথে প্রতিবন্ধক বলে দাবি করেছে ছাত্রফ্রন্ট। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রশ্নে খসড়া নীতির ওপর সংগঠনটির পর্যবেক্ষন ব্যতিক্রমী। তারা বলছে; ‘‘পূঁজিবাদী বিশ্বে দ্রুত প্রসারমান সার্ভিস সেক্টরে অংশগ্রহন করার তাগিদে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারন করলে তা দেশের অর্থনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে না। যেকোনো বিষয়ে বিস্তৃত ও গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন। তাছাড়া আউট সোর্সিং এর বাজার ধরার চেয়েও তথ্যপ্রযুক্তির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশীয় সম্পদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিল্প ও প্রযুক্তির সহায়ক হওয়া। মোট ৯ পৃষ্ঠার মতামতে ছাত্র ফ্রন্ট নারী শিক্ষার অংশ হিশাবে স্কুলে প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা’র বিরোধিতা করে বলছে- ‘‘এতে বিদ্যমান সামজিক ব্যবস্থায় প্রজনন স্বাস্থ্য সর্ম্পকে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারনা তৈরি হবার বদলে যৌনতাবিষয়ক অতিরিক্ত কৌতুহল তৈরি হওয়ার যথেষ্ট আশংকা আছে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সহজ সম্পর্ক নষ্ট হবে।’’ মতামতের শেষে ১০ দফা দাবির ভিত্তিতে শিক্ষানীতি প্রণয়নের দাবি করেছে তারা, যার শেষ দফাটি হচ্ছে- শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এর আগেও ছাত্রফ্রন্ট নানা ফোরামে নানা ভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছে যে, শিক্ষার ব্যায়ভার রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব আয় বাড়ানোর প্রেসক্রিপশন দিয়ে শিক্ষানীতির খসড়ার বক্তব্যের বিরোধিতা করেছে তারা। সংগঠনটির ভাষায়, ‘‘শিক্ষাকে ব্যবসার পণ্যে পরিনত করা হলে একদিকে শিক্ষার অধিকার সংকুচিত হয় অন্যদিকে শিক্ষার মূল্যবোধ নষ্ট হয়। মেধা ও প্রবণতা যাচাইয়ের যত সৎ উদ্দেশ্যের কথাই বলা হোক না কেন শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়া ছাড়া কোনভাবেই মেধা ও প্রবনতার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।’’ অন্যদিকে রঙিন মলাটে ও বাহারি সাদা কাগজে ২৪ পৃষ্ঠার পুস্তিকায় শিক্ষানীতির খসড়া প্রতিবেদন সর্ম্পকে মতামত প্রকাশ করলেও খুব বেশি বিষয়ে আপত্তি জানায়নি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ওই একই মতামত তারা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে জমা দিয়েছে। ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠন হিশাবে পরিচিত শিবির খসড়া প্রতিবেদনে যেসব ‘উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক’ চিহ্ণিত করেছে তার মধ্যে আছে- কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ, শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ৩০ নির্ধারন, সমমর্যাদাভূক্ত বা একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা চালুকরন, প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূরিকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহন, শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ন বিলুপ্তকরণ ও উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির কারণে নূন্যতম যোগ্যতার শর্ত শিথিল না করা। শিবির চিহ্ণিত ইতিবাচক দিকগুলোর বেশিরভাগই কাঠামো ও প্রক্রিয়াগত বিষয়। নীতিগত বিষয়ে শিক্ষানীতি ২০০৯ এর খসড়াকে তারা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ মনে করেছে। ধর্ম, নৈতিকতা ও মাদ্রাসা প্রশ্নে প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত নীতির বিরোধিতার তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি উপস্থাপন করেই মূলত তারা তাদের পুস্তিকাটি তৈরি করেছে। এবং সে আলোকে সভা সমাবেশ করে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জনমত প্রভাবিত করতে তাদের প্রচারণার মূল বক্তব্য হচ্ছে- সেকুলার আদর্শের শিক্ষা ব্যবস্থা অসাংবিধানিক এবং ধর্ম হচ্ছে নৈতিকতার প্রাচীন ও পরীক্ষিত উৎস। যেমন সংগঠনটি সংবিধানের আশ্রয় নিয়েছে এভাবে- ‘‘খসড়া রিপোর্টের ‘‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের এই অনুচেছদকে সুকৌশলে বিকৃত করে লেখা হয়েছে, ‘এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ি দেশে সেকুলার গনমুখী . . .’। এখানে সংবিধানের ‘একই পদ্ধতির গনমুখী’কে সুকৌশলে ‘সেকুলার গনমুখী’ বলা হয়েছে। অথচ সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদটি সম্পূর্ন অসাংবিধানিক।’’ উল্লেখ্য, শিক্ষাখাতে ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমানোর পক্ষে খসড়া প্রতিবেদনে যে নীতি প্রস্তাব করা হয়েছে সে বিষয়ে সংগঠনটি কোনো বক্তব্য রাখেনি।


নিজের সম্পর্কে লেখক



ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।