পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে করা রিট আবেদনের রায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও আইনি বিবর্তন নিয়া আলোচনা করেছেন আদালত। এ আলোচনা অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও আইনি বিবর্তনের সময়কাল আমরা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছি।

১৭৬০: এ বছর বাংলা প্রদেশের মুঘল গভর্নর তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলাকে ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন।

১৮৬০: এ সালে বৃটিশ উপনিবেশবাদী সরকার তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার কিছু এলাকা নিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করে।

১৯০০: এ বছর বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন- ১৯০০ এবং এর সাথে সম্পর্কিত বিধি বিধান তৈরি করে। ফলে পার্বত্য এলাকার প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল রেগুলেশন, বিধি এবং আদেশ একত্রে ‘হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল’ নামে পরিচিত। এর বিধান অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিচালিত হতে থাকে। ‘হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল’ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটা সার্কেলে ভাগ করা হয়। প্রথমত, চাকমা সার্কেল। সদর দপ্তর রাঙ্গামাটি। দ্বিতীয়ত, বোমাং সার্কেল। সদর দপ্তর বান্দরবান। তৃতীয়ত, মং সার্কেল। সদর দপ্তর খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি। সেসময় সার্কেলের নেতাকে ‘প্রধান’ এবং সাধারণভাবে ‘রাজা’ বা ‘কিং’ বলা হত। সার্কেল প্রধান বা রাজারা সবসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে প্রকাশ্যে এটা ডিপুটি কমিশনার বা সাব-ডিভিশনাল ডিপুটি কমিশনার দ্বারাই পরচালিত হয়েছে। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের একটা অংশ ছিল। কিন্তু ‘হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়াল’ অনুসারেই এই এলাকার প্রশাসন ভিন্ন আইন দ্বারা পরিচালিত হত। ফলে এটি একটা ‘অনিয়ন্ত্রিত জেলা’ বা ‘ননরেগুলেটেড ডিস্ট্রিক্ট’ এ পরিণত হয়।

১৯৩৫: এ সালে ১৯৩৫ আইন দ্বারা গঠিত বাংলা প্রদেশ তার অস্তিত্ব হারায় ও পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা নামে দুইটা নতুন প্রদেশের জন্ম হয়।

১৯৩৬: এ বছর গভর্নমেন্ট অব ইনডিয়া (এক্সক্লুডেড অ্যান্ড পার্টলি এক্সক্লুডেড এরিয়া ) অর্ডার- ১৯৩৬ এর দুই ধারা এবং তফসিল এর পার্ট ওয়ান দ্বারা বাংলা প্রদেশের অধীন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘বিচ্ছিন্ন অঞ্চল’ বা এক্সক্লুডেড এরিয়া হিশাবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৪৭: এ সালে দা ইনডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট- ১৯৪৭ অনুযায়ী ইনডিয়া ও পাকিস্তান নামে দুইটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। উনিশশ পঁয়ত্রিশ সালের আইন দ্বারা গঠিত বাংলা প্রদেশ তার অস্তিত্ব হারায় ও পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা নামে দুইটা নতুন প্রদেশের জন্ম হয়। উনিশশ সাতচল্লিশ সালের আইনের তফসিল ১-এ পূর্ববাংলা প্রদেশের বাংলা জেলাগুলো (বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট) অন্তর্ভুক্ত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এর মধ্যে ছিল না।

১৯৫৬: এ বছরে ১৯৩৫ সালের আইনটি-ই প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধনী সহ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান হিশাবে বহাল ছিল। ফলে সংশোধিত গভর্নমেন্ট অব ইনডিয়া এ্যাক্ট, ১৯৩৫ (বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানের কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি দ্বারা সংশোধিত হয়) অনুযায়ী বাংলা প্রদেশের একটা বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হিশাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে।

১৯৬২: এ বছর পাকিস্তানের ১৯৬২ সংবিধানের ২২২ ও ২২৩ অনুচ্ছেদে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ না করে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিশাবে আবার নামকরণ করা হয়।

১৯৭২: এ সালের শুরুর দিকে চারু বিকাশ চাকমা নামক একজন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর একটা প্রতিনিধি দল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং উপজাতিদের জন্য একটা আলাদা সাংবিধানিক সুরক্ষার (কনস্টিটিউশনাল সেফগার্ড) জন্য তাগিদ দেন। প্রতিনিধিদলের এ প্রচেষ্টার কোন ফল হয় নাই।

১৯৭২: বছরটার শুরুর দিকে সদ্য কায়েম হওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেসময় চট্টগ্রামের পাহাড়ীরা নাগরিক হিশাবে নতুন এই সংবিধানে তাদের অধিকার রাখার দাবিতে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। সে প্রচেষ্টারই অংশ হিশাবে ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে এম. এন লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা পিসিজেএসএস গঠন করা হয়।

১৯৭২: এ বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে আরও একটা প্রতিনিধিদল তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং চার দফা দাবি সম্বলিত সনদ পেশ করেন। চারটা দাবি হল:

(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন এবং একটা বিশেষ আইন প্রণয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা।

(খ) নতুন সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এর পুনপ্রবর্তন।

(গ) উপজাতি প্রধানদের দপ্তরগুলা বহাল রাখা।

(ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন- ১৯০০ এর সংশোধন নিষিদ্ধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী উপনিবেশন বা বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করে সংবিধানে একটা বিধান রাখা।

সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এ দাবিগুলা পুরাপুরি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি তাদেরকে একটা সংকীর্ণ ও জাতিগত চেতনা বাদ দিয়া জাতীয় সংহতি ও ঐক্যের স্বার্থে বৃহত্তর বাঙালী জাতীয়তাবাদের মাঝে মিশে থাকার আহ্বান জানান।

১৯৭২: এ বছরের নভেম্বরে সংবিধান গ্রহণের উদ্দেশ্যে সাংবিধানিক পরিষদের (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি হিশাবে মানবেন্দ্র লারমা সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক সুরক্ষার দাবি তোলেন। কিন্তু তার দাবিগুলা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ অবস্থায় বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়া তিনি সংবিধানটি গ্রহণের পক্ষে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকেন।

১৯৭২: এ বছরের ষোল ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। বাংলাদেশকে সাংবিধানিকভাবে একটা একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিশাবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৭২: এ বছর বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আগের আইনি মর্যাদা হারায়। সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে রাষ্ট্রের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিশাবে গণ্য করা হয়। প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য অংশের মত একই আইন দ্বারা পরিচালিত হবে এ অংশটি। আপাত কোন এলাকার ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকলেও প্রজাতন্ত্রের অধীন কোন এলাকাকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। বাংলাদেশের সংবিধান পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে ভোগ করা বিশেষ মর্যাদাকে চূড়ান্তভাবে বাতিল করে।

১৯৭৩: এ বছরের সাত জানুয়ারি ‘শান্তি বাহিনী’ নামে পিসিজেএসএস-এর একটা সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়। বাহিনীটা এক পর্যায়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর সরকারের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহী গোপন সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয়।

১৯৮৯: ‘সামরিক ও আংশিক বেসামরিক দ্বন্দ্বের’ পরিস্থিতিতে এ বছরের মার্চের ছয় তারিখে সংসদে একই ধরনের তিনটা আইন তৈরি হয়। আইনগুলা হল: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন- ১৯৮৯, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন- ১৯৮৯ এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন- ১৯৮৯। আইনগুলা দ্বারা তিনটি পার্বত্য জেলায় সংবিধানের ৫৯ নং অনুচ্ছেদের অধীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনগুলা স্থানান্তরিত বাঙ্গালী ও পাহাড়ী উভয়ের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় সরকারের গঠন ও কার্যপণালী সম্পর্কে বিস্তারিত বিধান আলোচনা করেছে।

১৯৯৭: এ বছরের দুই ডিসেম্বর, সরকারের তরফে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি বা এনসিসিএইচটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা পিসিজেএসএস-এর মধ্যে ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটা করার উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনা। চুক্তিটিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এনসিসিএইচটি এর সমন্বয়ক হিশাবে এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পিসিজেএসএস এর চেয়ারম্যান হিশাবে স্বাক্ষর করেন।

১৯৯৮: এ বছরের চব্বিশে মে শান্তি চুক্তিটির আইনি কার্যকারিতা দেয়ার জন্য মোট চারটা আইন পাশ করা হয়। আইনগুলা পাশ করার উদ্দেশ্য ছিল উনিশশ উনানব্বই সালের মূল আইনগুলা সংশোধন করা। আইনগুলা হল: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইন- ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ৯ নং আইন), বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইন- ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ১০ নং আইন), খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইন- ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ১১ নং আইন) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন- ১৯৯৮ (১৯৯৮ সালের ১২ নং আইন)।

 

আদালত চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের একটা বইকে উদ্ধৃত করে আলোচনা করছেন। রাজা ত্রিদিব রায় জোর দিয়া বলেছেন, ৭১ পরবর্তী সব ক্ষেত্রেই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন এবং জাতি গঠনের ভিত্তি এতটাই সংকীর্ণ ছিল যে, চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠী রাজ নৈতিকভাবে হীনম্মন্য এবং সাংবিধানিকভাবে কোণঠাসা হয়ে যায়।

আর বাদী ও বিবাদীদের যুক্তি তর্কের আলোচনা শেষে আদালতের কাছে এইটাই স্পষ্ট হয় যে, চট্টগ্রামের পাহাড়ী ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হত। আর পিটিশনকারীদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রক্রিয়া ওই সাংবিধানিক শূন্যতা থেকেই তৈরি হয়। আদতে এ জায়গায় দাঁড়িয়েই আদালত শান্তি প্রক্রিয়ার সাংবিধানিকতা নির্ধারণে সামনে এগিয়েছেন।

 


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : পার্বত্য চট্টগ্রাম, ইতিহাস, আইনি বিবর্তন

View: 4033 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD