ইরির পঞ্চাশ বছরপূর্তি ও রবার্ট জিগলারের বাংলাদেশ সফর


জলবায়ু পরিবর্তন প্লাস খাদ্য নিরাপত্তা ইকুয়েল টু জিএম ধান!

এখন শ্রাবণ মাস, কিন্তু বৃষ্টির কোন দেখা নেই। মাঝে মধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে একটু যেন মনে করিয়ে দেয় এখন বর্ষা কাল। জানি এক্ষুনি সবাই এক বাক্যে বলে উঠবেন এটাই তো জলবায়ু পরিবর্তন। বর্ষার সময় বৃষ্টি হবে না, গরমের সময় খরা এমন ভাবে হবে যে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে, আর শীতকাল অতি ছোট হবে, নয়তো বেশি শীত হবে, কুয়াশায় ফসলের ক্ষতি হবে অনেক। এই তো জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ! কৃষকরা ফসলের ব্যাপারে হিমসিম খাচ্ছেন।

কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন যতোই দুর্দশা বা সর্বনাশ বয়ে আনুক, কারো কারো ক্ষেত্রে পৌষ মাস হয়ে গেছে। আবহাওয়ার এই মতিগতি তাদের জন্য বড় ধরণের সুযোগ এনে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে প্রকৃতির এই বিরূপ মনোভাব যেন শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই সমাধান হয়ে যাবে। প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ কেন করছে তা যেন আর জানার বা বোঝার কোন দরকার নেই। যেমন বৃষ্টি তো শুধু ক্যলেন্ডারের তারিখ দেখে হয় না, এর জন্যে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার তা কি আছে? গত বছর (২০০৯) ডিসেম্বর মাসে কোপেহেগেনের ভেস্তে যাওয়া সম্মেলনের মুল বিষয় ছিল ধনী দেশের প্রযুক্তি নির্ভর অতি ভোগবাদী জীবন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে, নইলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া চলতেই থাকবে, আর গরিব দেশ ডুবে মরবে।

যারা সুযোগ নিতে চায় তাদের বড় একটি বিষয় হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা। সম্প্রতি এ নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (IRRI) ৫০ বছরপূর্তি বাংলাদেশে পালন করেছে ভাল কথা কিন্তু তাই বলে একেবারে আমাদের দেশে জিএম ধান প্রবর্তনের সুযোগ নিতে হবে কেন? গত ১৩ জুলাই, ২০১০ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইরি এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ আয়োজনে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে ইরির মহাপরিচালক রবার্ট জিগলারও উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সভা উদ্বোধনকালে দেশের ১৫ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিকূল পরিবেশসহনীয় নতুন জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি জানান ইরির সহযোগিতায় ব্রির বিজ্ঞানীরা ব্রি ধান–৫১ ও ব্রি ধান-৫২ উদ্ভাবন করেছে, যা বর্ষার পানিতে ডুবে গেলেও ফলন দেবে। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছেন ইরির সহযোগিতায় বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৫টি হাইব্রিড ও ৫০টি উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। দেশের ৭৫% জমিতে উফশী জাতের ধান চাষ হয় এবং ৮৭% চাল আসে এই জাত থেকে। তিনি ইরির কাছে অল্প দিনে উৎপাদিত হয় ও লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে সহযোগিতা চান। খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আর এক ধাপ এগিয়ে ইরির বিজ্ঞানীদের সুপার রাইস ও গোল্ডন রাইস উদ্ভাবনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা  নিশ্চিত করতে এই জাতগুলো কাজে লাগানোর ব্যাপারে ইরির সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। 

প্রথমত বলে রাখি, ইরির ৫০ বছরপূর্তির অনুষ্ঠান বাংলাদেশে করা ইরির জন্য খুব লাভ হয়েছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি হয়েছে। খোদ ইরি যে দেশে অবস্থিত সেই ফিলিপাইনসহ  এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ২০০৯ সাল থেকে ইরির ৫০ বছর উপলক্ষে কৃষক সংগঠনের পক্ষ থেকে  পরিষ্কারভাবে বলা হচ্ছে, ৫০ বছর যথেষ্ট, আর নয়, এবার আমাদের রেহাই দাও। তার কারণ গত শতাব্দির ষাটের দশকে আধুনিক কৃষি প্রবর্তন করে কৃষকদের উপকারের চেয়ে অপকার হয়েছে অনেক বেশি। এশিয়ার হাজার হাজার জাতের ধান ইরির জিন ব্যাংকে রেখে মাত্র ৫০টি ধান তারা দিয়েছে, যা উৎপাদন করতে গিয়ে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ভূগর্ভস্থ পানি তুলে পরিবেশের বারোটা বেজে গেছে। ইরির বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি হচ্ছে ইরি তার জিন ব্যাংকের সংগ্রহের জন্য ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার সকল ধান উৎপাদনকারী দেশ থেকে হাজার হাজার জাতের ধান নিয়ে দিয়েছে মাত্র ৫০টি। শুধু তাই নয় এই কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের মতো দাতারা শুধু ইরির বামুন জাতের উফশী ধান, [যার জন্যে সার-কীটনাশক ছাড়া উতপাদন হবে না], উপহার দিয়েছে এবং সেই ধানই উৎপাদন করতে কৃষকদের বলা যায় বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে ধানের বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে। ইরি কৃষকদের বীজ দিয়ে সহায়তা না করে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপের নামে বহুজাতিক কোম্পানি যেমন মনসান্তো, সিনজেন্তার হাতে ধানের বীজ সহজলভ্য করে দিয়েছে। তাছাড়া নিজের প্রযুক্তির ভুল স্বীকার না করে একটির পর একটি প্রযুক্তি নির্ভর ধান দিয়ে যাচ্ছে। উফশী ধানের পর দেয়া হল হাইব্রীড ধান, এখন জলবায়ু পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে জিএম ধান (জেনেটিকালি মডিফাইড ধান) বাংলাদেশের মত দেশে প্রবর্তনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইরি উফশী ধান শেষ পর্যন্ত উচ্চ ফলনের মাত্রা ধরে রাখতে পারে নি। হাইব্রীড বীজ আনার পর কৃষক বীজ হাতে রাখতে পারছে না। জিএম ধান আনা হলে কৃষকের ধান বলে আর কিছুই থাকবে না। কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমরা কি তাই চাই?   

রবার্ট জিগলার প্রথম আলোর কাছে একটি সাক্ষাতকারে (১৬ জুলাই, ২০১০ তারিখে প্রকাশিত) ইরির অনেক গুণগান করেছেন। মহাপরিচালক হিশেবে তিনি তা করারই কথা। এতে আমার বলার কিছু নাই। কিন্তু ইরি যদি এতোই সফল হবে তাহলে এখনো এতো খাদ্য ঘটতি থাকে কেন? ধান উৎপাদনকারী দেশ ধান আমদানীকারী হয় কেন? ভেতো বাঙালীকে রুটি আর আলু খেতে বলা হয় কেন? ইফতেখার মাহমুদের নেয়া এই সাক্ষাতকারের মধ্যে একটি বাক্য পড়ে খুব কৌতুক অনুভব করেছি তা হচ্ছে, ‘কোন ধরণের জিন বৈশিষ্ট্যের কারণে দুই সপ্তাহ পানির নিচে থাকলেও ধান নষ্ট হবে না তা ইরির কাছ থেকেই ব্রির বিজ্ঞানীরা জেনে কাজে লাগিয়েছেন। তবে এই জ্ঞানকে পুরোপুরি  কাজে লাগাতে হলে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।’’ বলতে পারেন আমি প্রায় জোরে হেসে ফেলেছি। এই ধরণের কথার বিরুদ্ধে আমাদের বিজ্ঞানীরা কোন প্রতিবাদ কেন করেন নি আমি জানি না। তবে আমাদের কৃষকদের যে জ্ঞান আছে তার জন্যে ইরির কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আমি এই লেখাটি লেখার সময় টাংগাইলের মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাইনুদ্দিনের কাছ থেকে জানলাম, এমন জাতের ধান অনেক আছে; যেমন পাট জাগ, লাল ঢেপা, সাদা ঢেপা, চামারা, হিজল দিঘা, কার্তিক ঝুল ইত্যাদি। তিনি বললেন এই ধান দুই তিন সপ্তাহ পানিতে থাকলেও নষ্ট হয় না, কুশি থাকলেই আবার ধান হবে। এই তথ্য পেতে আমার ৫ মিনিট সময়ও লাগে নি, তাহলে বিজ্ঞানীরা কষ্ট করে নিজের মান-মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কেন ইরির কাছে জ্ঞান নিতে যাচ্ছেন? ইরি তাদের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আর কি দেবে, তাইতো উচ্চতর প্রশিক্ষণের কথা উঠছে। জিগলার অবশ্য শুধু ধানের জিন নয় আমাদের বিজ্ঞানীদের জিন সম্পর্কেও জেনে ফেলেছেন। একই দিনের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় উদ্ধৃতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে জিগলারের একটি মন্তব্য দেয়া হয়েছে ‘ তাঁদের অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে গেলে আর দেশে ফেরেন না।’                       

এ বছরের বাজেটে (২০১০ – ১১) বিআর-৪৭ ধানের চাষের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণের কথা বলে উপকুলীয় অঞ্চলের ১০ লাখ হেক্টর লবণাক্ত এলাকার ৫০% জমিতে লবণাক্ততা প্রতিরোধক বিআর-৪৭ ধান আবাদের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বাজেটের পর সংবাদ সম্মেলন (১৭ জুন, ২০১০) করে  আমরা বলেছিলাম আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্থানীয় জাতের ধান, যার মধ্যে আনেকগুলারই উচ্চ ফলনের সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কালা বোরো, খৈয়া বোরো, চৈতা বোরো এবং টোপা বোরো। এইসব দেশীয় জাতের স্থানীয় আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারে। সরকার এমন ধান উৎপাদনে সহযোগিতা না করে নতুন ধান প্রচলন করছেন, যা ইতিমধ্যে কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। ২০০৯ - ১০ সালে বিআর-৪৭ উপকুলীয় অঞ্চলে সাফল্য দেখাতে পারে নি। এই তথ্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, আবার দক্ষিণাঞ্চলের বিজ্ঞানীরাও বলেছেন। আমরা দাবি করেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষকের জন্য গ্রহণযোগ্য এবং এলাকার পরিবেশের সাথে খাপ খায় এমন স্থানীয় জাতের ধান উৎপাদন করার জন্য সহায়তা দেয়া হোক। এখন দেখছি জিগলার সাহেবও ধানটি পছন্দ করেন নি। তিনি সমালোচনা করে বলেছেন ‘এই জাতটির প্রধান সমস্যা হচ্ছে তা পাকার পর কেটে আনার সময় মাটিতে ঝরে পড়ে, ফলে প্রচুর ধান নষ্ট হয়’। দেখা যাক সরকার এখন কি করেন। তবে ইরি এই ধানকে জেনেটিকালি পরিবর্তন করতে চায় কিনা, তা দেখার বিষয়।

সাক্ষাতকারে জিগলারের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইরির ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানা গেল।  তিনি বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত গোল্ডেন রাইস বা সোনালী ধানকে বংলাদেশের কৃষকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া ও চাষে উদ্বুদ্ধ করা হবে ইরি সামনের দিনের সব চেয়ে বড় পরিকল্পনা। তাঁর মতে এই ধানটি কৃষকদের ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদাও পূরণ করবে। এর অর্থ হচ্ছে ইরিকে ৫০ বছর পালন করার সুযোগ দিয়ে আমরা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ করে দিচ্ছি। সেই এজেন্ডা আর কিছুই নয়, ধানের বৈচিত্রের এই দেশে জিএম ধান প্রবর্তন, যা এই দেশের ধানের প্রতি হুমকী সৃষ্টি করবে। গোল্ডেন রাইসের কাজ শুরু হয়েছে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে বিবিসিকে বলেছিলেন তাঁর সরকার এই ধান প্রবর্তন করতে চান। আমরা তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। বর্তমান সরকারের কাছে জোট সরকারের সবকিছু খারাপ, তাহলে কি আশা করতে পারি যে অন্তত এই সরকার তাদের ঘোষিত একটি কর্মসূচি পালনের দায়িত্ব নেবে না?


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।