পাক্ষিক চিন্তা ৩০ অক্টোবর ২০১০ সংখ্যা


জনগণের ভূমি দখলকারী নয়, জনগনের সঙ্গে গণপ্রতিরক্ষার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে সেনাবাহিনীকে। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন আবাসন কোম্পানি আর্মি হাউজিং স্কিমের একটা প্রকল্পের জমি কেনাকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গত ২৩ অক্টোবর সেনাবাহিনী-র‌্যাব-পুলিশের সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের রেশ থাকতে থাকতেই আমাদের চিন্তার অভিমুখকে সেইদিকেই ফেরাবার সময় এসেছে। আরো পড়ুন...।

  • ইনডিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশের বিনিয়োগ এবং ট্রানজিট ফী'র ভবিষ্যৎ
  • বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে পরবর্তী যুদ্ধে শামিল করার কৌশল
  • হিজাব দেখলে লাগে ভয়
  • ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কনিয়ে আনা
  • বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা সংক্রান্ত রায়
  • অর্থশাস্ত্রের মৌলিক পুনর্গঠনে পিয়েরো স্রাফা
  • রোমিলা থাপারের দৃষ্টিতে বাব্রি মসজিদের রায়
  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০
  • ভাড়া বিদ্যুতের বেহাল দশা
  • আইওসিগুলোর কাছে জ্বালানিখাত জিম্মি করার বন্দোবস্ত চূড়ান্ত
  • মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ
  • আফগানিস্তানে যুদ্ধ ও 'সন্ত্রাস' আবিষ্কার কাহিনীর ভেতরবাড়ী

 

সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন আবাসন কোম্পানি আর্মি হাউজিং স্কিমের একটা প্রকল্পের জমি কেনাকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গত ২৩ অক্টোবর সেনাবাহিনী-র‌্যাব-পুলিশের সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের রেশ এখনও কাটে নাই ওই এলাকায়। সরকারি বাহিনীর গুলিতে জামাল উদ্দিন নামে একজন স্থানীয় অধিবাসী নিহত ও কমপক্ষে ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ইতিমধ্যে গত ২৫ অক্টোবর প্রায় চার হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে মামলা করেছে র‌্যাব। এর আগে প্রায় সমানসংখ্যক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে প্রথম মামলাটি করেছিল পুলিশ।

রূপগঞ্জ থানা সদর সহ প্রায় অর্ধশত গ্রামের সাধারণ মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে জাহেদ সরওয়ার নামে এক স্থানীয়আওয়ামী লীগ নেতা সহ বেশকিছু দালাল তাদের নানা ভাবে চাপ দিয়ে আসছিল আর্মি হাউজিং কোম্পানির কাছে জমি বিক্রি করতে। তারই প্রতিবাদ দানা বাঁধতে বাঁধতে ওইদিনের সংঘর্ষে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে প্রতিবাদী লোকজন আবাসন প্রকল্পের অংশ হিশাবে স্থাপিত সেনা ক্যাম্প অবরোধ করে।পরে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে সেনাসদস্যদের উদ্ধার করা হয়। কপ্টারে সেনাসদস্যরাউড়াল দেয়ার পর নিচে তাদের ক্যাম্পটি এলাকাবাসীর দেয়া আগুনে জ্বলছিল সেদিন। আর এখন ওইসব গ্রামের অধিবাসীরা পুলিশ ও র্যাড়বের মামলা ও গ্রেফতার থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর্মি হাউজিং স্কিম লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিমুল গণী সংবাদ মাধ্যমকেজানিয়েছেন যে, আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি কেনা চলবে।এই ঘটনার পর সাবেক সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা মণ্ডলীরসদস্য মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহ প্রশ্ন রাখেন যদি বেসরকারি হাউজিং প্রকল্প গড়ে উঠতে পারে তবে কেন সেনাবাহিনী তাদের বাসস্থানের জন্য আবাসন প্রকল্প গড়তে পারবে না? একজন সাবেক সেনাপ্রধানের এমন প্রশ্ন থেকে টের পাওয়া যায় যে, খোদ বাহিনীর শীর্ষ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে জাতীয় প্রতিরক্ষাবাহিনীর পেশাদারিত্ব ক্ষুণ্ণ হয় এমন ধরনের কাজে নিয়োজিত করতে বেশ আগ্রহী। তাও আবার এমন ধরনের একটিস্পর্শকাতর বিষয়ে সম্পৃক্ত করা যেখানে সাধারণ মানুষের সাথে দূরত্ব বাড়ে; বিরোধ ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার মত আশঙ্কাজনক কাজে সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকে।

নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে জমিন কেনার জন্য এই প্রকল্পে কী বিবেচনায় সরাসরি সেনাবাহিনীর পরিচালনায় তদারকির অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা বোধগম্য না।রাজউক বা সরকারের নিজস্ব প্রকল্পের বাইরে এরকম একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক আবাসন পরিকল্পনার সাথে যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীকে জড়িয়েছে, তাদেরকে অবশ্যই এর দায়দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ও বহুল পরিচিত ভূমিদস্যুদের কাতারেই শুধু শামিল না বরং যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। সীমা অতিক্রম করার আবহ সৃষ্টির বিপদজনক ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, এর আগে অন্যকোথাও এমনকি সেনাবাহিনীর এই প্রকল্পের পাশে অপরাপর কোম্পানিগুলোর জমি ক্রয়ে অনিয়ম এবং জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ এভাবে ফুঁসে উঠে নাই। এর তাৎপর্য এবং ভয়াবহতা সৈনিক এবং পেশাদারিত্বের প্রতি এখনও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তারা কতটুকু বুঝবেন কে জানে!

ওই স্কিমের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, বাহিনীতে কর্মরতও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আবাসনের কথা চিন্তা করে এই আবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই লক্ষ্যে একটা প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে পাঠানো হয়। গতবছর ২০০৯-এর ২৩ নভেম্বরে এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ওই প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরে গত বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে আর্মি হাউজিং স্কিমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। পরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটি একটি সীমিতকোম্পানি হিশাবে নিবন্ধিত হয়। কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল ইকবালুর করীম ভূঁইয়া হচ্ছেন কোম্পানির চেয়ারম্যান।কোম্পানিটি ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে পর্যায় ক্রমে আবাসন প্রকল্প করবে বলে জানিয়েছে। প্রথম প্রকল্প হিশাবে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এই প্রকল্পটি শুরু করে। মোট১৩ হাজার বিঘা আয়তনের ওই প্রকল্পটির জন্য গত ১৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জমি কেনার কাজ শুরু হয়। সর্বশেষ তথ্যমতে, একহাজার বিঘার কিছু বেশি পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। মোট ২৭ হাজার প্লটের ওই প্রকল্পে প্রতি প্লটের দাম হবে গড়ে ১৫ লক্ষ টাকা। সেনা মালিকানাধীন ট্রাস্টব্যাংক থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেয়ার সুযোগ আছে।

আবাসিক প্লট ছাড়াও কোম্পানি প্রকল্প-এলাকায় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য জায়গা বিক্রি করা হবে। ২০১৫ সাল নাগাদ প্রকল্প শেষ হবে বলে ধার্য করা হয়েছে। কোম্পানি জানিয়েছে, বাজারের অন্যান্য আবাসন কোম্পানিগুলার মত দরেই প্লট বিক্রি করা হবে। ইতিমধ্যেইকোম্পানিটি প্রায় ৭ হাজার সেনা কর্মকর্তাকে প্লটের ক্রেতা তাহিশাবে নিবন্ধন দিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে প্লটের মূল্য বাবদ দুই কিস্তির টাকাও নিয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী রাজউকের অনুমোদন পাওয়ার আগে প্লট বুকিং বা বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করা পুরাপুরি বেআইনি।

প্রথাগত জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর ধারণার বাইরে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এখন একটা বিশাল মিলিটারি করপোরেশন হয়ে উঠছে। আর এই করপোরেট ব্যবসায়ের অংশ হিশাবেই রূপগঞ্জের মত নানা জায়গায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করতে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। আর দশটা রিয়েলএস্টেট কোম্পানির মতই শুধু না, বরং সশস্ত্র সেনাসদস্যদের দিয়ে ক্যাম্প বসিয়ে ওখানে জমি কেনার কাজে লাগানো হচ্ছে। কৃষি ও অকৃষি জমি জোরজবরে দখল করে আবাসন ব্যবসা করনেওয়ালা অন্যান্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাড়তি সুবিধা নিতে চাইছে তারা। এক ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগত কাঠামো ব্যবহার করে বল প্রয়োগের বিষয়টা আপাতত বিবেচনার বাইরে রাখলেও, সেনাবাহিনী কোন ধারণা-পূর্বানুমান ও পরিস্থিতিতে এধরনের উদ্যোগকে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজের অংশ করে নিচ্ছে, কেন ও কিভাবে এটা করছে তারা, সেটা বুঝতে হলে এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে সৈনিকতার মর্যাদা, জাতীয় প্রতিরক্ষার অঙ্গিকারের প্রতি দুর্বলতা এবং শান্তি মিশনকেন্দ্রিক একটি ভাড়াখাটা মানসিকতার বাহিনীতে দিনকেদিন নিজেদের নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া বুঝতে হবে। জনগণের সাথে মৈত্রী, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত বাহিনীআকারে এর আর ন্যূনতম গণমুখি চরিত্রও মানুষের কাছে অবশিষ্ট থাকছে না।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।