এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন


দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে পুলিশ যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে তাকে নির্বিচার গণহত্যা ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিক থেকে আর কিছুই বলা যায় না। বিক্ষোভ ও মিছিল দেখলেই গুলি করবার নির্দেশ পালন করছে পুলিশ। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে হত্যার উৎসব চলছে। কাদের মোল্লার রায়ে কেন তাকে ফাঁসি দেওয়া হোল না একদল তার বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির ছয় তারিখ থেকে শাহবাগে  অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে, দাবি করছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার নয়, যেভাবেই হোক ফাঁসি দিতে হবে। ফাঁসির রায় ছাড়া শাহবাগ  ঘরে ফিরবে না। আদালতের ওপর এই অন্যায় চাপ অব্যাহত রাখা হয়েছে। এটা ঘটছে প্রকাশ্যে। পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ক্ষমতার চাপ।

আদালত  দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এই অভিযোগ নতুন নয়। ফলে চাপ ভেতর থেকেও আছে। পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে রাজপথে ক্ষমতা জারি রেখে ও রায়ের ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে শাহবাগ  দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জ হয়ে আদালতের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থান মূলত শুধু আদালত অবমাননা নয়, রীতিমতো বিচারব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার শামিল হয়ে উঠেছে। আদালতের সওয়াল-জবাব  ও বিদ্যমান আইনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কাউকে বিচারক ফাঁসি দিতে না পারেন তবুও তাকে, শাহবাগ দাবি করছে, ফাঁসীই দিতে হবে। বিচার করো কিন্তু ফাঁসি ছাড়া আর কোন রায় মানি না দাবি করলে সেটা হয় আদালতের নাম ভাঙ্গিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাবার নির্দেশ চাওয়া। পিটিয়ে মানুষ মারার মত ব্যাপার,  যে হত্যায় আদালতকে অংশগ্রহণের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। শাহবাগ এই ধরণের পাবলিক লিঞ্চিং বা গণ অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। হাটে কাউকে ছেলেধরা হিসাবে অভিযুক্ত করে রব তুললে সকলে মিলে পিটিয়ে যেভাবে তাকে  হত্যা করে, তাকেই বলে পাবলিক লিঞ্চিং। আমি ভদ্র ভাষায় অনুবাদ করেছি গণ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। অথচ একেই কিছু গণমাধ্যম আখ্যা দিয়েছে ‘গণ জাগরণ’। গণ জাগরণ মঞ্চ বিচার নয়, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চায়। আইনী প্রক্রিয়ায় ফলাফল হিশাবে কাউকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব হলেও তাকে ফাঁসি দিতে হবে। শাহবাগ আদালতকেও এই পাবলিক লিঞ্চিং-এর সহযোগী করে নিয়েছে। এই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করলে আমরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কিছুই বুঝবো না।


গণ জাগরণ মঞ্চ বিচার নয়, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চায়। আইনী প্রক্রিয়ায় ফলাফল হিশাবে কাউকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব হলেও তাকে ফাঁসি দিতে হবে। শাহবাগ আদালতকেও এই পাবলিক লিঞ্চিং-এর সহযোগী করে নিয়েছে। এই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করলে আমরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার কিছুই বুঝবো না।


আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি শাহবাগে সুস্থ ভাবে চিন্তা করতে সক্ষম এমন মানুষের অভাব নাই। এই দেশকে তারা ভালবাসেন। তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ করে নি, কিন্তু তার গল্প শুনেছে । মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের নিখাদ ভালবাসা আমাদের অনায়াসেই বিশাল এক উল্লম্ফনের সম্ভাবনা তৈরী করেছে। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হয় নি এই ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত। এর ফলে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে একটি বড় ধরণের ক্ষত সৃষ্টি হয়ে আছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হলে অবশ্যই এই ক্ষত নিরাময় করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তার অর্থ পাবলিক লিঞ্চিং যেমন হতে পারে না, তেমনি যারা রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে তাদের নির্বিচার গুলি করাও আমরা সমর্থন করতে পারি না। জামাত-শিবিরের রাজনীতি অপছন্দ করি বলে, কিম্বা আমাদের অবচেতনে ইসলাম সম্পর্কে আতংক ও ঘৃণা কাজ করবার কারণে এই ক্ষেত্রে সকলপ্রকার বিবেচনা ও মানবতাবোধ আমরা হারিয়ে ফেলতে পারি না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে অবিলম্বে পুলিশী বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, বিক্ষোভ  সহিংস হলেও অবিলম্বে তার কারন অনুসন্ধান করা। নির্বিচার গুলি চালাবার ক্ষেত্রে পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমশন গঠন করা এখন খুবই জরুরী। চোখের সামনে আমরা যদি বাংলাদেশের ভেঙ্গে পড়া দেখতে না চাই তাহলে এই দাবি আমাদের সকলকেই তুলতে হবে।

এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে। পুলিশও নিহত হয়েছে। একেও আমাদের নিন্দা করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিক্ষোভ ও হরতাল সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। ক্ষমতাসীনরা বারবারই এই অধিকার লংঘন করেছে এবং বিক্ষোভ ও হরতাল প্রতিহত করবার জন্য তাদের দলীয় কর্মীদের পুলিশের ছত্রছায়ায় অস্ত্র হাতে নামিয়ে দিয়েছে।এবারও আমরা দেখেছি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক তার দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশকে ‘সহায়তা’  করবার নির্দেশ দিয়েছেন (নিউ এইজ ১ মার্চ ২০১৩)।এটা আওয়ামী রাজনীতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট। এর মধ্য দিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডাররা একাকার হয়ে গিয়েছে। সরকার এই ক্ষেত্রে সরাসরি আইনের বরখেলাফ করেছে। যা ভয়াবহ ও বিপজ্জনক। ক্ষোভ প্রকাশের নাগরিক ও মানবিক অধিকার অস্বীকার করলে পরিস্থিতি অনিবার্য ভাবেই চরম সহিংসতার দিকে চলে যায়।এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তখন বিক্ষোভকারীদের কাছে পুলিশ দলীয় ক্যাডার ছাড়া ভিন্ন ভাবে বিবেচিত হয় না। আইনী সীমার মধ্যে থেকে পুলিশকে তার দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় নি। নিরপেক্ষ ও আইনসঙ্গত ভূমিকা পালন করতে না দিয়ে পুলিশকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত করার কুফল হচ্ছে নির্বিচার হত্যা। মনে রাখতে হবে পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সন্ত্রাসী ভূমিকায় নামলে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে পালটা বলপ্রয়োগের পক্ষে জনমত তৈরী হয়। বিক্ষোভ পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় গড়ায়। থানা আক্রমণ ও পুলিশের হত্যার দায় দায়িত্ব এখন এই সরকারকেই নিতে হবে। আশা করি পুলিশ বাহিনীর যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হবেন এবং নিজেদের আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করবেন না।


পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সন্ত্রাসী ভূমিকায় নামলে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে পালটা বলপ্রয়োগের পক্ষে জনমত তৈরী হয়। বিক্ষোভ পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতায় গড়ায়। থানা আক্রমণ ও পুলিশের হত্যার দায় দায়িত্ব এখন এই সরকারকেই নিতে হবে। আশা করি পুলিশ বাহিনীর যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা এই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক হবেন এবং নিজেদের আওয়ামী ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করবেন না।


দলীয় ক্যাডারদের পুলিশের সঙ্গে নামিয়ে দেবার পর পুলিশ যখন পালটা হামলার মুখে পড়ে তখন তাকে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ হিশাবে কতিপয় গণমাধ্যমের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীনরা প্রচার করছে। এতে নাগরিক হিশাবে আমাদের বিভ্রান্ত হবার কোন কারণ নাই। আইনের সীমা কারুরই লংঘন উচিত নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে যেভাবে ব্যবহার করছে সেই প্রশ্ন উহ্য রেখে তাদের ওপর বিক্ষোভকারীদের আক্রমণ যারা নিন্দা করছেন তাদের সঙ্গে আমরা একমত নই। সরকারের কাছে আমাদের দাবি  জানাতে হবে পুলিশ কোন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার নয়, তাকে সেইভাবে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবক্ষয় ত্বরান্বিত করবেন না। আইন শৃংখলা বাহিনীর কোন সদস্য যদি সেই ভূমিকা পালন করে তাহলে প্রশাসনিক ভাবে জবাবদিহীর ব্যবস্থা করুন।

আমরা এখনও গণতন্ত্রকে নিছকই একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছাড়া অধিক কিছু ভাবি না। এই ভুল ধারণার বিপদ ধরা পড়ে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাকে  বিচার করবার অক্ষমতার মধ্যে। আমরা মনে করি একটি দল নির্বাচিত হয়েছে বলেই এই দল গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচন হয়েছে বলে বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক। এখন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি বাংলাদেশ কি আসলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার যে কোন মূল্যে রক্ষা করে। যদি আমরা মনে করি ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে শাহবাগে ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই বললে পুলিশ আমাদের পাহারা দেবে, খানাপিনা, টয়লেট, পানি সরবরাহ করবে। আর কেউ সেই শ্লোগান না দিলে তাকে গুলি করে রাষ্ট্র হত্যা করবে তখন এই রাষ্ট্রকে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক বলা চলে না।

যে হত্যাকাণ্ড চলেছে তার সঙ্গে পাকিস্তান আমলেরও তুলনা করা চলে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ বছরে ২৫ মার্চ পর্যন্ত এতো মানুষ হত্যা করে নি, যতো মানুষ শেখ হাসিনার সরকার শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে খুন করেছে। সরকারী সমর্থিত পত্রিকাগুলো তথ্য গোপন করলেও গত চব্বিশঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে  ৬০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। যারা গুলিতে আহত হয়ে মারা যাচ্ছেন তাদের হিশাব আমরা জানি না। গত রাত ১১টা পর্যন্ত আমার দেশের খবর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ৫৬। আমরা যদি পুলিশের এই নির্বিচার গুলি বর্ষণের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার না হই তাহলে সাধারণ মানুষের রক্তে এই দেশ পিচ্ছিল হয়ে যাবে।

এর জন্যই কি এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল?

১ মার্চ ২০১৩। ১৭ ফাল্গুন ১৪১৯। শুক্রবার


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।