মোসাদ: গুপ্তহত্যার লাইসেন্সওয়ালা পর্যটকরা এখানেই থামবে না


নিজেদের কাজের অংশ হিশাবে তথা, কৌশলগত সামরিক পরিকল্পনার আওতায় দুনিয়ার পরাক্রমশালী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কমবেশি গুপ্তহত্যা চালায়। পাশাপাশি বিভিন্ন অন্তর্ঘাত মূলক তৎপরতাও চালিয়ে থাকে সমান তালে। বিশেষত, রাজনীতিকভাবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে নাজুক করে তোলার জন্য যা প্রায়শ কার্যকর মাধ্যম হিশেবে ব্যবহার করা হয়।

আর বিগত আধাশতাব্দি ধরে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ গুপ্তহত্যা চালানোকে একটা প্রতিষ্ঠিত রেয়াজে পরিণত করেছে। যা তাদের সামরিক পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ ও অবধারিত অংশ বলে গৃহীত। এমনিতে সংস্থাটির কোনো অভিযানের অংশ হিশাবে এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটে না, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করার জন্যই অভিযান চালায় মোসাদ। গুপ্তহত্যার অভিযান-- নিশানা করা ব্যক্তিকে গোপনে খুন। সুপরিকল্পিত, ক্ষিপ্র এবং নৃশংস। কিন্তু তাদের সর্বশেষ অভিযানকে নানা কারণেই আর দশটা গুপ্তহত্যার মতো করে মেনে নিতে পারে নি ইওরোপীয়ান দেশগুলো থেকে শুরু করে আরব আমীরাতও। সম্প্রতি আমীরাতের রাজধানী দুবাইয়ে অভিযান চালিয়ে হামাসের এক নেতাকে হত্যা করার পর নানা দেশের তরফ থেকে বেনজির চাপের মুখে পড়েছে ইসরাইল। কিন্তু তারপরও এধরনের গোপন অভিযান কিংবা গুপ্তহত্যাকে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কার্যক্রমের তালিকায় উপরের দিকেই রাখে দেশটি। ইসরায়েলের এইসব কার্যক্রমের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ছাপ দক্ষিণ এশিয়ায়ও পড়তে বাধ্য। লিখেছেন সাইফ শিশির ও মোহাম্মদ আরজু

 

ইসরায়েল তার সর্বশেষ ‘টার্গেটেড কিলিং’ অভিযান সফলভাবে চালালো অন্য একটি দেশে, আরব আমীরাতের দুবাইয়ে, হামাসের এক সামরিক কমান্ডারকে হত্যা করে মোসাদ। এ বছরের ২০ জানুয়ারির ওই হত্যাকাণ্ডটির জন্য এখন মোসাদকে সপ্রমান দায়ী করা হচ্ছে। দুবাই কর্তৃপক্ষ আততায়ীদের ছবি প্রকাশ করেছে, যাদের ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার বলে চিহ্নিত করেছেন তারা। আততায়ীরা দুবাইতে আসে ফ্রান্স, জর্মানি ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের পাসপোর্ট নিয়ে। যার মানে হচ্ছে ওই দেশগুলোর নাগরিক তথ্যভান্ডার (ন্যাশনাল আইডেন্টিটি ডাটাবেজ) জালিয়াতি করে পাসপোর্ট হাতিয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা। স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের সাথে অন্যরকম এক টানাপোড়েনে জড়িয়েছে এখন ওই দেশগুলো। জর্মানি ও ফ্রান্সের গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে মোসাদের মতো দক্ষ সংস্থাগুলোর পক্ষেই কেবল ওই ধরনের অভিযান চালানো সম্ভব। জর্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘটনার পরপরই ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। ফরাসী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে ইসরায়েলের কাছে। ব্রিটেন সরকারিভাবেই জানিয়েছে যে, হামাস কমান্ডার মাহবুদ আল মাবু’র হত্যাকারী যে মোসাদ এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। আয়ারল্যান্ড জানিয়েছে ‘আইরিশ পাসপোর্টের সুনাম ক্ষতিগ্রস্থ করে এমনসব কর্মকান্ডকে তারা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা’ করবে।

ফ্রান্স, জর্মানি, ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বর্তমান প্রতিক্রিয়া থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, দুবাই হত্যাকাণ্ডের বেলায় ওসব দেশের কোনো নিরাপত্তা সংস্থার সাথে ইসরায়েলের যোগাযোগ ছিল না। তাহলে জোরদার ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন দেশগুলোর স্পর্শকাতর তথ্যভান্ডারে জালিয়াতি করা--নিজস্ব কিলিং স্কোয়াডের সদস্যদের জন্য সেইসব দেশের পাসপোর্ট হাতিয়ে ব্যবহার করার মতো বেপরোয়া উদ্যোগ ইসরায়েল নিচ্ছে কেন ? এই প্রশ্নের জবাব আছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নীতি এবং সে সম্পর্কে নিজের নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেই। নিজেদের রাষ্ট্রের সুরক্ষা প্রসঙ্গে ইসরায়েলিদের মধ্যে খুব একটা মতের ফারাক নাই। প্রায় সবার দৃষ্টিভঙ্গী এরকম যে, যে কোনো সময় যেকোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের শত্রুদের নির্মূল করার সামর্থ্য থাকে--তবেই কেবল বলা যায় রাষ্ট্রের সুরক্ষার সামর্থ্য আছে। এবং এধরনের সামর্থ্যরে প্রমাণ ইসরায়েল বরাবরই দিয়ে আসছে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ও প্রধানত মোসাদের মাধ্যমে। দখলকৃত ভূমিতে কর্মরত মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বরাবর জানিয়ে আসছে যে, শুধু ‘টার্গেটেড কিলিং’-এই দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। অধিকাংশ ইসরায়েলি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে।

ইসরায়েল তার নিরাপত্তা প্রশ্নে এধরনের ‘মরিয়া নীতি’র সপক্ষে ধারাবাহিক প্রচারণা ও উদ্বুদ্ধকরনের মাধ্যমে নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে পাশে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে সফলভাবে দেশে, দখলকৃত ভূমিতে সহ সারা দুনিয়া জুড়ে এমনভাবে অভিযান পরিচালনা করে আসছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা, সংস্থাটি ১৯৫১ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরপরই গঠিত হয়। দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন সেসময় মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘প্রতিরক্ষায় সম্মুখ ব্যুহ’ হিসাবে মোসাদ কাজ করবে। সে কথামতোই কাজ করছে তারা। ঝুঁকি না বাড়িয়ে আগেভাগেই নিরাপত্তার প্রতি সম্ভাব্য হুমকি দূর করতে সচেষ্ট সংস্থাটি। একাজে কোনো আন্তর্জাতিক আইন, কূটনীতিক রীতিপ্রথার তোয়াক্কা করেনা দেশটি। অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে হলে দেশটি তার ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করতে সক্রিয়, এমনকি বন্ধু দেশ হলেও। জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষণ ও নীতি নির্ধারনেও সম্মুখ সারির ভূমিকা রাখে গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। দেশের বাইরে অভিযান চালানোর জন্য গঠিত শাখা ছাড়া আরো দুটি শাখা আছে এর- অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শাখা ও সামরিক গোয়েন্দা শাখা।

mosadতবে দুনিয়াবাসী মোসাদ বলতে মোসাদের বৈদেশিক শাখাকেই জানে। কারণ, দুনিয়াজুড়ে দুর্দান্ত সব অভিযান আর নৃশংস সব হত্যকাণ্ড চালানোর জন্য মশহুর হয়েছে শাখাটি। যেমন, নাজি বাহিনীর এক সামরিক নেতা--এডলফ ইচম্যানকে ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসে তারা। তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আর্জেন্টিনা তখন জাতিসংঘে অভিযোগ দায়ের কররে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের অভিযোগ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তাৎক্ষণিকভাবে এর সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরিষদ জানায়, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করতে পারে। কিন্তু পরিষদের ওই প্রস্তাব ইসরায়েলকে কখনো ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা’ বিঘ্নিতকারী ঘটনা থেকে বিরত রাখতে পারে নি। দেশের ভেতরে, দখলকৃত ফিলিস্তিনে, মিসর-সিরিয়া-জর্দান থেকে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইওরোপেও নানা গুপ্ত হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালানোর অভিযোগ আছে দেশটির বিরুদ্ধে। এসব মরিয়া অভিযানে সাফল্যের পাশাপাশি আছে ব্যর্থতাও। দু’ ধরনের ব্যর্থতা; এক. অভিযান সফল করতে না পারা, দুই. সফল অভিযানের পর মোসাদের সম্পৃক্ততা প্রকাশ হয়ে যাওয়া।

প্রথম ধরনের ব্যর্থতার একটি নজির হতে পারে ১৯৯৭’র জর্দানে গুপ্তহত্যা অভিযান। প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের সিদ্ধান্তে মোসাদ জর্দানের রাজধানী আম্মানে অভিযান চালায় হামাসের রাজনৈতিক নেতা খালিদ মিশালকে হত্যা করার জন্য। লেথাল নার্ভ টক্সিক--মারাত্মক বিষাক্ত এক ধরনের বিষ যা চামড়ার স্পর্শে আসলে প্রাণীর মৃত্যু নিশ্চিত--সেই নার্ভ টক্সিক মিশালের ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে গোয়েন্দারা। কিন্তু মিশালের দেহরক্ষীরা দুই গোয়েন্দাকে আগেইভাগেই আটক করে। অন্য চারজন গোয়েন্দা ইসরায়েলি দূতাবাসে আশ্রয় নিলে জর্দানের সেনাবাহিনী দূতাবাস ঘেরাও করে। আটককৃতদের ফেরত পেতে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জর্দানে আসেন, কিন্তু বাদশাহ হোসেইন ঘটনার প্রতিবাদে তাকে সাক্ষাত দিতে অস্বীকার করেন। নেতানিয়াহু ক্ষমাপ্রার্থনা করলেও জর্দানের তরফ থেকে কোনো নমনীয়তা দেখানো হয় নি। দীর্ঘ আলোচনার পর বাধ্য হয়ে নার্ভ টক্সিকের প্রতিষেধক সরবরাহ করে ইসরায়েল, এর আগে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্তৃক টক্সিক হামলার শিকার ব্যক্তিদের সুস্থ করে তুলতে ওই প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়। আটককৃত দুই গোয়েন্দার মুক্তির বিনিময়ে হামাসের নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিন সহ বেশ কিছু জর্দানি ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। (সাত বছর পরে এই শেখ ইয়াসিনকে হত্যা করে ইসরায়েল, হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে হামলা করে)। তারপরও দুদেশের কূটনীতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়, বিদ্যমান একটি শান্তিচুক্তি কার্যত বাতিল হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ওই দুই গোয়েন্দা পর্যটক ভিসায় জর্দানে গিয়েছিলেন, এবং তাদের পাসপোর্ট ছিল কানাডিয়। জালিয়াতির মাধ্যমে কানাডিয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে গুপ্তহামলা করার কারণে, কানাডার সাথে ইসরায়েলের কূটনীতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

১৯৯৭ এ ব্যর্থ আম্মান হত্যাপ্রচেষ্টার পর তখন ইসরায়েলের হয়ে পুরো মুশকিল সামাল দিয়েছিলেন যিনি, সেই নেতানিয়াহু এখন আবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। তাকে সামাল দিতে হচ্ছে দুবাই ঘটনার জের। এবারে মোসাদ সফলভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারলেও সন্দেহভাজন ২৬ জনকে চিহ্নিত করেছে দুবাই কর্তৃপক্ষ এবং ১১ জনের ব্যবহৃত পাসপোর্ট থেকে নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে। যাদের ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার লোক বলে অভিযোগ করছেন তারা। প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থারই আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন, মোসাদ কখনোই কোনো ফাঁস হয়ে যাওয়া ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা কোনোভাবেই মেনে নেয় না, বিন্দুমাত্র ইঙ্গিতও দেয় না। অস্বীকার করে সোজাসুজি। কিন্তু এবার অভিযোগ মেনে নেয়া কিংবা অস্বীকার, কোনোটিই করছে না তারা। ওদিকে জাতীয় স্পর্শকাতর ডাটাবেজে অনুপ্রবেশ ও পাসপোর্ট জালিয়াতির শিকার হওয়া ইওরোপীয় দেশগুলো তদন্ত শুরু করেছে। এবং দুবাই কর্তৃপক্ষ গত তেসরা মার্চ স্বয়ং নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করার আহবান জানিয়েছে ইন্টারপোলের কাছে। পাশাপাশি মোসাদ প্রধানকে গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোলকে পরোয়ানা ইস্যু করতে আহ্বান জানিয়েছে তারা। এই আহবানের বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি ইসরায়েল।

অবশ্য ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাভিদগর লিবারম্যান যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইওরোপীয় দেশগুলোর চাওয়া কৈফিয়তের জবাবে, সেখান থেকে বোঝা যায়--দেশটি মনে করছে তারা এই টানাপোড়েন সামাল দিতে পারবে বড় কোনো সমস্যার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া। বারবার কিছুটা বিরক্তিভাব নিয়েই তিনি সংবাদ মাধ্যমে যা বলেছেন তার সারকথা হলো; ‘এসব প্রশ্নে ইসরায়েলের প্রতি কেন সবার আগে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়? কেন অন্য দেশ যখন গুপ্তহত্যা চালায় তখন সেটিকে এত নিন্দা করা হয় না, এত আলোচনা করা হয় না?’ কিন্তু তাকে এই প্রশ্ন করার সুযোগ সংবাদ মাধ্যম নেয় নি যে জালিয়াতি করে বন্ধুপ্রতীম দেশের পাসপোর্ট হাতানোর মতো কাজ কোনো দেশ করেছে কি? বা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যাকে জাতীয় প্রতিরক্ষার প্রধানতম নিয়মিত হাতিয়ার হিসাবে অন্য কোনো দেশ নিয়েছে কি? অবশ্য ইসরায়েল জানে যে, এসব ঘটনায় আইনি প্রশ্ন যতই উঠুক কিংবা আর্ন্তজাতিক তরফে যতই নিন্দা হোক তারা ধরাছোয়ার বাইরেই থাকতে পারবে। যেমনটি প্রমাণ পাওয়া যায়, নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারে দুবাইয়ের আহ্বানের প্রেক্ষিতে ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায়। সরকার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না জানালেও একজন মুখপাত্র নাম না প্রকাশ করার শর্তে দি ফিলাডেলফিয়া ইনকোয়ারার কে বলেন ‘দুবাই পুলিশের সংবাদকক্ষ থেকে গ্রেফতারের বিষয়টি আর সামনে এগোবে--এমন সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।’

এই সম্ভবনার অনুপস্থিতি একটা কারণ তো বটেই, আরো নানা কারণে এটা বলা যাচ্ছে যে, দেশটি গুপ্তহত্যার কৌশল থেকে সরে আসবে না। দেশটি মনে করে, নিয়মিত সামরিক বাহিনী নয় এমন অপ্রচলিত ধরনের বাহিনীর বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা একটি কার্যকর উপায়। তাছাড়া দেশটির নিরাপত্তা নীতি নির্ধারকরা মনে করেন ইসরায়েল বিরোধী গেরিলা সংগঠনগুলোকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য অনেক সময় সামর্থ্য খরচ করতে বাধ্য করতে পারে একমাত্র গুপ্তহত্যাই। লেবাননের সাথে ২০০৬ সালে যুদ্ধে ইসরায়েলের নিয়মিত সামরিক বাহিনী যেভাবে কার্যত পরাজিত হয়, তার তুলনায় মোসাদের এতদিনকার গুপ্তহত্যার সাফল্য নিশ্চয় ইসরায়েলের জন্য সুখকর। লেবাননের সাথে পরাজয়ের বছরেই, ২০০৬ সালে দেশটির সুপ্রিমকোর্টও গুপ্তহত্যা অভিযানকে আর্ন্তজাতিক আইনসম্মত বলে ঘোষণা দিয়ে এ অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষে রায় দেয়। কাজেই, আন্তজাতিক ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হলেও দেশটি এমন কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবে।

যদিও ১৯৯৭ তে আম্মানে ব্যর্থতার পরেও দেশটি এমন অভিযানকে উচ্চমাত্রায় ঝুকিপূর্ণ আখ্যায়িত করে এমন অভিযান আর না করার কথা জানিয়েছিল। এখন যেমন নানা তরফে অমন প্রচারনা চালানো হচ্ছে। গত ৪ মার্চ ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক বিশাল শিরোনাম করেছে যে, দুবাই হত্যাকাণ্ড হচেছ ‘দি লাস্ট অ্যাসাসিনেশন অফ দিস কাইন্ড’। পত্রিকাটির ইন্টেলিজেন্স করেসপন্ডেন্ট ইয়োশি মেম্যান এই ঘটনার পরে ইসরায়েলের সরকারের অবস্থান কি হতে পারে তা ব্যাখ্যা করার দাবি করেছেন প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হচ্ছে, নজরদারি করার মতো প্রযুক্তির ছড়াছড়ির এই সময়ে গুপ্তহত্যা চালানো কঠিন হবে। কাজেই সরকার এ উপায় ছাড়ার কথা ভাবছে। ইয়োশি লিখছেন, দুবাই অভিযানের ঘটনা যেসব প্রযুক্তির ফলে প্রকাশিত হয়ে পড়লো এগুলো খেলার নিয়ম পাল্টে দিয়েছে। তার ভাষায়, ‘জেমস বন্ডের চলচ্চিত্রের কেতায় বীরত্বব্যঞ্জক অভিযান চালানোর দিন শেষ।’

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, হারেটজ এর এই খবর মূলত ইসরায়েল কর্তৃক দুনিয়াবাসীকে ‘আশ্বস্ত’ করার চেষ্টা মাত্র। যেমনটি করা হয়েছিল ৯৭ তে। কারণ- প্রথমত, যেসব ইওরোপীয় দেশের জাতীয় পরিচয়সংক্রান্ত তথ্যভান্ডার থেকে ওই সব দেশের নাগরিকদের নামেই পাসপোর্ট ইস্যু করে ব্যবহার করেছে মোসাদের গোয়েন্দারা--এমন ঘটনার পর তথ্যভান্ডারে সাধারন তল্লাশি চালালেই যে তা প্রকাশ হয়ে পড়বে, এটা নিশ্চয় ইসরায়েল বুঝতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের সাথে দুবাইয়ের আরো অনেক আরব দেশের মতো কূটনীতিক সম্পর্ক নেই। তারপরও নিজেদের ভাবমুর্তির দিকে খেয়াল রেখেই হয়তো অন্য দেশের নাগরিকত্ব আছে এমন ইহুদিদের পর্যটক হিসাবে ভ্রমণে দুবাই কর্তৃপক্ষ উদারতা দেখায়। কিন্তু নজরদারি থাকে অনেক কড়া। এই নজরদারির কথা নিশ্চয় মোসাদের জানা ছিল। তৃতীয়ত, এই ইলেকট্রনিক লেনদেনের যুগে কোনো ভ্রমনকারিই নিজের উপস্থিতির চিহ্ন না রেখে ভ্রমণ করতে পারে না। ভিসা পাওয়ার শর্ত পূরণ করতে গোয়েন্দাদের প্রি-পেইড ক্যাশ কার্ড ছিল এবং সেগুলো তারা ব্যবহারও করেছেন। এই ক্যাশ কার্ড কে কবে কোথায় ব্যবহার করেছেন সেই সূত্র ধরে যে কাউকে খুঁজে বের করা যে সম্ভব সেটাও নিশ্চয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানতেন। চতুর্থত এবং চূড়ান্তভাবে বলতে হয়, যে হোটেলে মাবহুকে খুন করা হয় তার বাইরে রাস্তায়, ভিতরে লবিতে-করিডোরে এবং মাবহুর কক্ষে চালু থাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা নিশ্চয় গোয়েন্দাদের অজানা ছিল না।

কাজেই সরকারের হয়ে যেই ‘উপলদ্ধি’র কথা জানায় দৈনিক হারেটজ তা যে প্রকৃত মনোভাব নয় সেটা স্পষ্ট। কারণ এসব নজরদারির কথা ইসরায়েলের ভালোভাবেই জানে। গোয়েন্দারাও অভিযানকালে দেখতে পাচ্ছিলেন যে, তাদের সব চলাফেরার দৃশ্য আর আলামতই সংরক্ষিত হচ্ছে। এরপরও তারা অভিযান চালিয়েছেন পরিকল্পনা অনুযায়ী, সফল হয়েছেন এবং নিরাপদে ফিরেছেন। তার মানে কি? তার মানে হচ্ছে, এটা তারা পাত্তাই দেন নি। এই পাত্তা না দেয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, এক. তারা জানতেন তাদের যেসব মুখের ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়ছে বা যেসব ক্যাশ কার্ড তারা ব্যবহার করছেন সেসব মুখ আর দ্বীতিয়বার কোনো অভিযানে দেখা যাবে না বা ওই ক্যাশ কার্ড আর কখনো ব্যবহৃত হবে না, কারণ ওটা তাদের এমন জরুরি অভিযান, যে অভিযান একজন এজেন্টের সারা জীবনের জন্য যথেষ্ট, বাকীটা সময় ঘরের ছেলে হয়ে ঘরে থাকলেও আলবত চলে। দুই. যেসব মুখের ছবি প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো গোয়েন্দাদের প্রকৃত মুখ নাও হতে পারে, হয়তো দাড়িওয়ালা মুখটি এই অভিযানের জন্যই দাড়ি পুষেছেন কিংবা টাকমাথাওয়ালা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্যই টাক হয়েছেন। তিন. যদি মুখগুলো অভিযান পরিচালনাকারীদের সত্যি চেহারা হয় তবে তো প্লাস্টিক সার্জারি আছেই।

mossad agentকাজেই নজরদারির প্রযুক্তির কারণে ইসরায়েল গুপ্তহত্যা বন্ধ করবে সেটা সত্যি নয়। বরং তার এসব প্রযুক্তির হুমকি এবং হুমকি রোধ করা, দুই বিষয়েই সচেতন ও সক্রিয়। দুবাই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইসরায়েল যেটা শুরু করলো- ভুয়া পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র বানানোর পুরনো পদ্ধতির বদলে অন্য দেশের ডাটাবেজ থেকে পরিচয় চুরি করে দলিলপত্র তৈরি করা, সেই পরিচয়ে লক্ষ্যস্থলে প্রবেশ করা, অভিযান চালিয়ে হত্যা করা এবং অভিযানকারীদের ফিরিয়ে এনে গোপনে রাখা; এভাবেই বরং ইসরায়েল তার ‘মরিয়া ধরনের প্রতিরক্ষা নীতি’ চালু রাখবে।

এখন, দক্ষিণ এশিয়ার দিকে তাকালে আমরা যে বিপদের দিকটা আচ করতে পারি তা হলো, গত একদশকে ভারতের সাথে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বেড়ে ওঠা ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও যোগযোগ। নানান কারণে এটা বেশ পাকাপোক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে। বিশেষত, ভারতের র'এর সাথে তাদের কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক ও পরস্পরের নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি অভিন্ন দর্শনকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এর আওতায় মোসাদের তত্তাবধানে সরাসরি প্রশিক্ষত করে তোলার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে বেশ আগে থেকেই। লক্ষণীয় দিক হলো, মোসাদ তথা ইসরায়েলের মতো ভারতেরও সামনের সারির সামরিক কৌশলের অংশ হিশেবে গুপ্তহত্যা কিংবা টার্গেটেড কিলিং মিশনের কৌশল গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের স্বক্ষমতা তৈরি এবং ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবার কথা। বাংলাদেশের নিরাপত্তার হুমকি মোকাবেলা এই দিকটি আশু বিবেচনায় আনা উচিত। অন্যদিকে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয় ও নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা সমূহের দিকে নজর ফেরানোও যেতে পারে এই আলোকে।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।