ইনডিয়ার পানি আগ্রাসন ও নিরাপত্তা ঝুঁকি


ফারাক্কা ব্যারেজ, স্পাই-থ্রিলার ও দক্ষিণ এশিয়ায় আশু সংঘাত

এক.

বাংলাদেশের এই জমিন তৈরি করেছে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে যাওয়া নদ-নদী, তারা জলের সাথে বয়ে এনেছে পলি, কণা কণা পলি জমে জমে তৈরি হয়েছে আমাদের পায়ের নীচের মাটি- বদ্বীপ বাংলাদেশ। এই দেশের বিশাল সবুজে যেই প্রকৃতি ও প্রাণের সমারোহ, সেই সমস্ত আয়োজন নিশ্চিত হয় জলের বিপুল প্রবাহে। পানি ও প্রাণের এক অবিচ্ছেদ্য মানিক-জোড়। পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশ ও প্রাণব্যবস্থার টিকে থাকার অলঙ্ঘনীয় শর্ত হচ্ছে জলের এমন অবাধ প্রবাহ। অথচ বাংলাদেশের বেলায় জলের এই চলাচল আটকে দিচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, ইনডিয়া। বাংলাদেশের মানুষ সহ সব প্রাণের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে- প্রাণব্যবস্থা, প্রাণবৈচিত্র বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। মরুকরণ ও লবনাক্ততার মতো বিভীষিকায় ফেলছে বাংলাদেশকে। সবচাইতে সরাসরি যেই ক্ষতি চোখের সামনে থেকে আড়াল হওয়ার উপায় নাই- তা হচ্ছে; সারা বছরজুড়ে মরা, আধমরা আর প্রায় মরে মরে দশার নদীগুলার- ভর বর্ষার প্রচুর পানি ধরে রাখতে অক্ষম নদীগুলার আশপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষের স্রোত। ভিটে-মাটি, জীবন-জীবিকা হারানোর কষ্ট ও ক্রোধ বুকের মধ্যে নিয়া নিরুপায় মানুষেরা ছড়িয়ে পড়ছে তারা, এখানে সেখানে।

বাংলাদেশের মতো ছোট রাষ্ট্রের সাথে এই ইনডিয়ার বৈরিভাব, অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীগুলার নিজেদের অংশে বাধ, ড্যাম, ব্যারাজ সহ নদীসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে গায়ের জোরে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে থাকা- এসবের বুঝি আর কোনো শেষ নাই। দুশমনির এই ধারাবাহিকতা যদি ইনডিয়া বজায় রাখে, তবে এই সংকট যে কোনো সময় তুমুল প্রতিরোধের রূপ নিতে পারে। আর সেই তুমুল প্রতিরোধ কোনোভাবেই এতদিন ধরে চলে আসা বাংলাদেশ-ইনডিয়ার দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিশাবে থাকবে না। কিন্তু কেন থাকবে না? কেন এটা দুই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়বে? সমস্যার কী এমন গুণগত পরিবর্তন এবং চরিত্রগত ভিন্নতা তৈরি হয়েছে? কি কি নতুন উপাদান এসে যুক্ত হয়েছে এর মধ্যে? এসব বিষয়ে কথা-বার্তা বলা জরুরি। সেই চেষ্টা আমরা করবো নিশ্চয়ই।

তবে তার আগে ছোট্ট একটা খবর দেই। বিশ্লেষণ আকরে না হলেও, সাহিত্য আকারে সেই চেষ্টার নজির এর মধ্যেই আমাদের চোখে পড়েছে। এইসব বিষয়ের ইশারা-অনুমান কিম্বা বলা যায় সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতির আগাম একটা চিত্র ইতোমধ্যেই একজন একেছেন- যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক এক ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা-ডুয়ান ইভান্স (Duane Evans) । দুই হাজার সাত সালে সিআইয়ের দায়িত্ব থেকে অবসরে যাওয়া উচ্চপদস্থ এই আমেরিকান গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডুয়ান ইভান্স একটি স্পাই থ্রিলার লিখেছেন— নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা (North From Calcutta) ।

গেল বছর বইটি বের হওয়ার পরপরই বিশ্লেষকদের মনোযোগ কাড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান টানাপোড়েনগুলার মধ্যে একটার সাথে আরেকটার খায়খাতির কতো বিশাল পরিণতি ডেকে আনতে পারে, তারই ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন ইভান্স তার এই উপন্যাসে- নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা’য়। উপন্যাসে লেখক ইনডিয়া ও পাকিস্তানকে কর্তার ভূমিকায় রাখলেও পুরা কাহীনি ঘুরে ফিরে বাংলাদেশেকেই ঘিরে থেকেছে। বাংলাদেশ, মানে ইনডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরানা ও প্রধান সমস্যা- পানি সমস্যা ঘিরেই উপন্যাসের কাহীনি। বইয়ের প্লট হিসেবে লেখক ‘ফারাক্কা সমস্যা’কে বেছে নিয়েছেন। একটা ‘সন্ত্রাসী হামলায়’ ফারাক্কা ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনার সুতা ধরে একটু একটু করে আগাতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী। বইটাকে শুধু ‘স্পাই থ্রিলার’ বললে সবটা বলা হয় না। এটা আসলে আর্ন্তজাতিক ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াই- পানি ও প্রাণসম্পদের ওপরে কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত নিয়ন্ত্রণ কায়েমের রাজনীতি- ইত্যাদি বিষয়ে এমন একটা ‘ভাষ্য’ যার কাঠামোটা ‘উপন্যাসে’র, উপন্যাসের চরিত্র হচ্ছে ‘গোয়েন্দা-গল্পে’র । গল্পের চল বেশ টানটান, নানা মাত্রার আর সম্পর্কের যোগসূত্র তৈরি করা হয়েছে এই গোয়েন্দা ভাষ্যে।

farakka

......................

শুকনো মরুময়, পানি শূন্য নদীর বুক থেকে উঠে আসছে হাহাকার। আর নদীলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকার অনোন্যপায় সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য লড়াইয়ের দৃশ্যমান বাস্তবতা।

.......................

পাকিস্তানের সামরিক ইন্টেলিজেন্সের একজন চৌকস- মানে সবকাজে পাকা অফিসার- তারেক দুররানি। তাকে সরকার ডেকে পাঠায় নবগঠিত একটি সংস্থা- আইআরই–এ, উদ্দেশ্য; ফারাক্কা ব্যারেজের ডিজাইন ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। ১৯৭১ সনে বানানো ২,২৫০ মিটার লম্বা ড্যাম এই ফারাক্কা, যেটা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যায়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল, এই ফারাক্কা নিয়া বাংলাদেশ সালিশ চাইছে জাতিসংঘে । একই প্রকল্পের অংশ জঙ্গিপুর ক্যানেল, যেটা দিয়া গঙ্গা থেকে হুগলি নদীতে পানি সরানোর কাজ শুরু করে ইনডিয়া ১৯৭৫ সনে। একচল্লিশ দিন সময়ের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করার কথা বলে আজো এটা বন্ধ করে নাই ইনডিয়া। শুকনা মৌসুমে পানি সরিয়ে নেয়ার জন্য যা ব্যবহার করা হয়, সেই ব্যারেজ ব্যবহার করেই আবার বর্ষাকালে প্রচুর পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ভাসানো হয়। এই ব্যারেজের প্রভাবে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ, খরা, ফসলহানি হচ্ছে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন লবনাক্ততায় আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলছে। অথচ ইনডিয়ান ইউনিয়েনের কেন্দ্রীয় সরকার এসব স্বীকার করতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এসবের জন্য তারা দায়ী না, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং নদীর পতিপথ সরে যাওয়ার ফলে এটা ঘটেছে। বাংলাদেশ নিরুপায় হয়ে ফোরাম জাতিসংঘকে সালিশ মানছে, সেখানে তারা এর একটা ফায়সালা চাচ্ছে। বাংলাদেশের দাবি শুকনো মৌসুমে ব্যারেজের গেট খুলে দিতে হবে। না হলে এই বিপর্যয় রোধ করা অসম্ভব। কিন্তু ইনডিয়া এই দাবির কানাকড়িও মানতে নারাজ। এই পটভূমিতে পিছন থেকে বাংলাদেশকে জোরালো দাবি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে চাচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস। পুরো কাজটি সমন্বয় করছে পাকিস্তানে নবগঠিত সংস্থা- আইআরই। সে জন্যই মেজর তারেক দুররানির ডাক পড়েছে।

অন্যদিকে, ফারাক্কা ব্যারেজের ২৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে একটি ব্যাপকমাত্রার উৎসবের আয়োজন করছে ইনডিয়া। সেখানে এই প্রকল্পের মূল স্থপতিকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে। তাছাড়া সারা দুনিয়ার দৃষ্টি এখন এই দিকে, কাজেই এর সুযোগ নেবে ইনডিয়া। একে উপলক্ষ করে স্থাপনা ও নির্মাণখাতে নিজেদের সাফল্য এবং শক্তি প্রদর্শনের জোর আয়োজনে ব্যস্ত দেশটি। বিভিন্নদেশের রাষ্ট্রদূত, ব্যবসায়ী ও বড় বড় বিনিয়াগকারীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। ফারাক্কা ব্যারেজের স্থপতি-কন্যা সাহার আদভানি’র কণ্ঠে ঝরে পড়ছে প্রবল উচ্ছ্বাস; ইতোমধ্যে ঘটনা চক্রে সে প্রেমে পড়েছে সেই মেজর তারেক দুররানির, তারেককে তাই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করছে প্রবল উৎসাহে, সাহার বলছে; ‘I think you would be impressed by Farakka Barrage. It is going to be a big event, with some senior government officials in attendance, as well as foreign dignitaries’’ । উচ্ছ্বাসের এই প্রাবল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নদ-নদী, কৃষি ও পরিবেশ বিধ্বংসী বাধ বহাল রাখার আগ্রাসী ক্ষমতায় সন্তুষ্ট ইনডিয়া একই সাথে কৌশল ঠিক করেছে- কিভাবে এই বিতর্ক থেকে ফায়দা তুলবে সে। অতিথিদের অভ্যর্থনায় নিয়োজিত সরকারি প্রটোকল অফিসার অনিলের কথায় সেই নিষ্ঠুরতা ও নিখুত কূটনীতিক কৌশলের উদযাপন লক্ষ্য করা যায়, ‘It’s actually a clever strategy, whether India wins or loses in the debate. A high-profile ceremony highliting the dam will emphasize the point that India bows to no one on internal issues. Oviously, that is why our deputy U.N. rep will be here’।

অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীতে বাধ দিয়ে আরেকটি দেশকে শুকিয়ে মরুভূমি বানানোর পরও কিভাবে এই ইস্যুটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার থাকে? অন্যকারো কাছে ‘নত’ না হওয়ার দম্ভ প্রকাশ করতে পারে দেশটি? পারে। কারণ, এর পরই আমরা উপন্যাসের নায়ক তারেকের মাধ্যমে জানতে পারি জাতিসংঘ ভোট দিয়েছে ইনডিয়ার পক্ষে। বাংলাদেশের অস্তিত্ত বিপন্ন হয়ে যাওয়ার মুখেও আন্তর্জাতিক কোনো উদ্বেগ তৈরি হয় নাই। প্রকল্পটি বন্ধ করার কোনো নির্দেশ জারি করা হয় নাই ইনডিয়ার প্রতি। বাংলাদেশের হতাশ প্রতিনিধি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে বের হয়ে আসেন। চরম অসহায় অবস্থা, কূটনীতিকভাবে বাংলাদেশের আর কিছু্‌ই করার থাকল না।

বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকেরই এরকম পরিস্থিতে আতঙ্কিত হওয়ার কথা। কেউ অবশ্য হাফ ছেড়ে বাচতেও চাইতে পারেন; ইভান্সের কাল্পনিক এ ছবি হুবহু বাস্তবে না ঘটারই সম্ভাবনা- এ বলে যে কেউ নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেন। কিম্বা সত্যি সত্যিই এই সমস্যা থেকে- সর্বোচ্চ আর্ন্তজাতিক ফোরাম জাতিসংঘের এমনভাবে ইনডিয়ার প্রতি সমর্থনের বিপদ থেকে, হয়তো বাংলাদেশ বেঁচেও যেতে পারতো। কিন্তু ইভান্সের এই কল্পভাষ্যের বাইরে আমরা সম্প্রতি অন্য ঘটনা দেখেছি। নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা উপন্যাসে বলা এই কল্প-বিপদকে বাস্তবে রুপ দিতে অনেক দূর এগিয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সফরে তিনি ইনডিয়াকে আনুষ্ঠানিক ওয়াদা দিয়ে এসেছেন যে, জাতিসংঘে ইনডিয়ার স্থায়ী সদস্যপদ লাভে তিনি দেশটিকে সমর্থন দেবেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যত বাংলাদেশের মৃত্যু পরোয়ানায় নিজের হাতে সই করে এসেছেন। ইনডিয়া যদি জাতিসংঘে স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে, তবে পানি সমস্যা- ফারাক্কা সমস্যা- সীমান্ত বিরোধ ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার বিষয়ে সালিশ বা শুনানি তো দূরের কথা, এগুলো আলোচনার জন্য উঠানোর সুযোগই বন্ধ হয়ে যাবে। যেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কূটনীতিক কার্যক্রম প্রসারিত করা দরকার, সেখানে বরং উল্টো আত্মঘাতী কবর রচনার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ আগ্রসর হচ্ছে। এতদূর পর্যন্ত কি অনুমান করতে পেরেছিলেন ডুয়ানে ইভান্স?

বিপদের ঘনঘটার ভেতর আচমকা জানা যায়, আইআরই নিজের কাজের পাশাপাশি অন্য এক ক্ষেত্রে এলটি’কে সহায়তা করছে। অ্যাটোমিক ডিমলিশার দিয়ে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ ২৫ বছর পূর্তি’র জমকালো উৎসবের সময় ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার কাজে আইএরআই সাহায্য করছে অন্য একটি সংগঠনকে- এলটি’কে। সেখানে এলটি বা আইআরই-এর কমন স্বার্থ হচ্ছে কাশ্মিরে সার্বক্ষণিক যুদ্ধে নিয়োজিত বিশাল ইনডিয়ান সেনাবাহিনীর ভারসাম্যের বদল ঘটানো। তাদের ক্ষমতা কমিয়ে শক্তির হিশাবে নিজেদের এগিয়ে থাকার শর্ত তৈরি করা। আবার অদ্ভুতভাবে, ইভান্স ইঙ্গিতে দেখাচ্ছেন যে, ব্যারেজ উড়িয়ে দেবার অপারেশনে নিয়োজিত বাহীনির সাতজন সদস্য বাংলায় কথা বলে। ব্যাস, এটুকুই তথ্য এবিষয়ে, আর বেশি কিছু নয়। ফারাক্কা ব্যারেজ উড়িয়ে দিতে অতি উচ্চমাত্রার এক ‘সন্ত্রাসী’ হামলায় রওয়ানা হয়েছে যারা, তাদের কাফেলার সাত জন বাংলায় কথা বলে। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সব কূটনীতিক চেষ্টা যখন বিফল, বাংলাদেশে অস্তিত্বের প্রতি হুমকি যে ব্যারেজ- সে ব্যারেজ বিষয়ে জাতিসংঘও যখন কিছু করছে না। তখন সেই ব্যারেজ উড়িয়ে দেবে লস্কর-ই-তাইয়েবার একদল লোক! এরা কারা? তারা কি মরুপ্রায় শুকনো নদীর চরে জীবন-জীবিকার শর্ত হারানো উন্মুল কেউ? তারা কি এমন কেউ যারা ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু? ফারাক্কা ব্যারেজে এই হামলার পাশাপাশি, বারো ঘন্টার মধ্যেই আবার উত্তর-পূর্ব ইনডিয়ার স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীরাও যুদ্ধ শুরু করবে। চারদিক থেকে কোনঠাসা করে যাদেরকেও এই সমীকরণে ঠেলে দিয়েছে ইনডিয়া, তারা যুক্ত হয়েছে এই সমস্যার সাথে অনিবার্যভাবে। কি হতে যাচ্ছে তাহলে? কি করবে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের মানুষ? কল্পনা আর নিরাপত্তা ঝুকির অনুমান নির্ভর এক গোয়েন্দাভাষ্যে সম্ভব-অসম্ভবের মানচিত্র ফুটে উঠছে। সেখানে বঞ্চনা ও ক্রোধ, অসহায়ত্ব ও প্রতিশোধের বারুদে কি অগ্নিশিখা জ্বলে উঠবে? তাছাড়া যেভাবে বাস্তব ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে তাতে করে কি ঘটবে ইভান্সের উপন্যাসের বাইরে?

দুই.

north from calcutta

...........................

ডুয়ান ইভান্স নিউ মেক্সিকো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। তারপর, সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কাজে যোগ দিয়ে নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রাগ-এ ৮২ এয়ারব্রোন ডিভিশনে নিয়োজিত হন। স্পেশাল ফোর্স অফিসার প্রশিক্ষণ সহ রেঞ্জার স্কুল করেন। এবং সেনাবাহিনীতে প্যারাশুটিঙে মাস্টার রেটিংও পান।

ছয় বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর, ১৯৮৩ সনে সিআই-এ যোগদান করেন। বিদেশে ইভান্স অপারশেন অফিসারের দায়িত্ব পালন করতেন। মাঠপর্যায়ের সর্বোচ্চ পদ স্টেশন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইন্টেলিজেন্স স্টার খেতাব পান। দীর্ঘদিন দিল্লীতে কর্মরত ছিলেন। চারটি মহাদেশ কাজেরসূত্রে বিচরণ করেছেন। সিআইএ থেকে অবসরে যান ২০০৭ সনে। এটা তার পয়লা উপন্যাস—যা লেখার পরিকল্পনা করছিলেন সেই ১৯৯৫ থেকে। অবশেষে গতবছর শেষ হয়ে তা বই আকারে বের হয়।

..........................

উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী এই লড়াইয়ে হঠাৎ যুক্ত হতে গেল কেনো? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ ইনডিয়া সফরে যেমনতরো ‘নিরাপত্তা’ চুক্তি করে এসেছেন- সফর শেষে ঘোষিত সমঝোতা ইশতেহারে যেমন সাফসাফ ইশারা পাওয়া যায়- বাংলাদেশকে একটা সম্প্রসারিত যুদ্ধের পক্ষভূক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; তাতে মনে হচ্ছে ইভান্সের ইঙ্গিত বাস্তবায়নের পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, হয়তো সহসাই।

বাংলাদেশ ও ইনডিয়ার দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠক শেষে, দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাশিত ওই যৌথ ইশতেহারে মোট একান্নটি দফা আছে। প্রথম বারোটি দফায় কূটনীতিক রেওয়াজ পালন করা হয়েছে- বৈঠকের প্রেক্ষাপট, উপস্থিত প্রতিনিধিদলের সদস্য ইত্যাদি বিষয়ের গতানুগতিক বর্ণনা। তবে সেখানে ইনডিয়ার প্রতিনিধি দলে একজন ব্যক্তির উপস্থিতি ঠিক ‘গতানুগতিক’ বলে ধরে নেয়া যাচ্ছেনা। ইনডিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা- শ্রী টি.কে.এ. নায়ারের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। কারণ, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কোনো নীতিনির্ধারক সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

সফরের আগে থেকেই তিনটা চুক্তিনির্দিষ্ট করা ছিল। এসব চুক্তির সব বিশয়াষয় ‘নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগিতা’ বলে সফরের মাসখানেক আগে থেকে তুমুল প্রচার চালানো হয়। আসলে এই নিরাপত্তা কার জন্য এবং বাংলাদেশ কেন এটাকে নিজের রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে জায়গা দেবে, এই বিষয়ে ঝুকিপূর্ণ রাজনৈতিক অবন্থান নেবে, এই নিয়ে নাগরিকেদের মত-অমত ও সামাজিক সমর্থন যাচাই করা তো দূরের কথা- কোনো ধরনের জাতীয় সংলাপ বা আলোচনা তোলা হয়নি। জাতীয় পরিসরে সে ধরনের আলোচনা অবশ্য দুই সরকারের জন্যই অসুবিধে তৈরি করতে পারতো, কারণ চুক্তিগুলার আসল উদ্দেশ্যটাই আড়াল করে হাজির করা হয়েছে মানুষের সামনে।

পরাশক্তির চালু করা জিনিশ- ‘সন্ত্রাস’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ ঠিক কি জিনিশ সেই বিষয়ে দুনিয়ার মানুষ একমত না- তবু ‘সন্ত্রাস’ আর ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রতিরোধের নামে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এই সুযোগে ইনডিয়া তার নিজের দেশের ভেতরের বা আঞ্চলিক সমস্যাকে ওই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র কাতারে ফেলে একই কায়দায় সমাধানের রাস্তা খুঁজছে। সেই বিপজ্জনক রাস্তায় দেশটি বাংলাদেশকে টেনে নিতে চাইছিল বহুদিন ধরে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের টুইন-টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর থেকে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির মওকা পেয়ে জব্বর চাপাচাপিতে ফেলে দিয়েছিল । কিন্তু এবার চাপাচাপি করে নিজের শক্তি খরচ করা তো লাগলোই না, বরং একদম অনায়াসে-- একেবারে আয়েশ করে নিজের যুদ্ধাভিযানের সারথি বানিয়ে নিলো। এই যুদ্ধ ইনডিয়ান ইউনিয়নের নানা রাজ্যভূক্ত নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইউনিয়নভূক্ত নানা অঞ্চলে দখলদারি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-নির্যাতন, বলপ্রয়োগ ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তির লড়াই নির্মূল করার এই যুদ্ধে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শামিল করলেন।

দমন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায়সঙ্গত বিক্ষোভ ও বিদ্রোহকে নিরাপত্তার সমস্যা হিসেবে দেখার নীতি ইনডিয়া নিতেই পারে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের কেন একইভাবে শামিল হতে যাবে? নিজের রাষ্ট্রীয় নীতির-নিরাপত্তার বিবেচনা ছাড়া, বিনা প্রশ্ন ও বাক্য ব্যয়ে বাংলাদেশ কেন ইনডিয়ার যুদ্ধযাত্রায় সঙ্গী হবে? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নাই সরকারের কাছে। অবশ্য কখনো সখনো এটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, এসব চুক্তির ফলে ইনডিয়ায় পালিয়ে যাওয়া সুব্রত বাইনদের মতো অপরাধী- চাঁদাবাজ আর ভাড়াটে খুনিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইনের মধ্যে সাধারন অপরাধী, অন্যদিকে ইনডিয়ার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইরত গেরিলা বাহীনিগুলার সদস্যদের এক কাতারে ফেলে বিবেচনা করছেন তারা; এতে করে পুরা পরিস্থিতেকে তারা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক করে তুলছেন- বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত করে তুলছেন। দেশের আভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সহায় হবে- একথা বলে বাংলাদেশে যেভাবে একটা দীর্ঘমেয়াদী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যুদ্ধাভিযানে পক্ষ নিচ্ছে এটা রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে মস্ত ঝুকির মধ্যে ফেলে দেবে। পররাষ্ট্রনীতির জায়গা থেকে নিদেনপক্ষে নিরপেক্ষ না থেকে এই যুদ্ধে সরাসরি ইনডিয়ার পক্ষ নেয়ার ফল কি হবে সেটা বোঝার সময়ও বাংলাদেশ পাবে কি না, সন্দেহ আছে। ইনডিয়াও যে পার পেয়ে যাবে সেই সুযোগ নাই, খেসারত ইনডিয়াকেও কড়ায়গন্ডায় গুণতে হবে- যদি ইভান্স ঠিক ঠিক বুঝে থাকেন। সেই প্রসঙ্গে খানিক পরে আসছি।

যদি বাংলাদেশে আসলেই নিজেদের নিরাপত্তা সংহত করতে নতুন কোনো উদ্যোগ দরকার আছে বলে ধার্য করে, তবে সেটা ইনডিয়া-ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাস বিরোধী প্রকল্পে’র বাইরে থেকেও করা সম্ভব। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-নৈতিক ভিত্তি ও কৌশলকে ভিত্তিকে করেই সেটা সম্ভব। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের এটা এক দিক থেকে সুবিধেরও ছিল। কিন্তু সে দিকে না গিয়ে সরকার নিজেই বিপদের দিকে পা বাড়িয়েছে। নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের নৈতিক ও ঐতিহাসিক সংবেদনার যে ভিত্তি আছে, সেই ভিত্তি থেকেই ইনডিয়ার পূর্বাঞ্চলের সাতবোন থেকে কাশ্মির পর্যন্ত চলমান আত্মনিয়ন্ত্রণ কায়েমের লড়াইকে বিবেচনা করতে পারতো বাংলাদেশ। এই বিবেচনা থাকা উচিত নিজেদের রাষ্ট্রীয় শক্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থেই; কোনে ভাবাবেগ বা সংকীর্ণ বিদ্বেষ পোষণের মামলা এটা নয়। একটি স্বীকৃত ও বৈধ রাজনৈতিক লড়াইকেও ইনডিয়ার সাথে সাথে শেখ হাসিনা যেভাবে একাকার করে ফেলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই ইভান্সের কল্পিত ছক মাফিক যুদ্ধের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে এই অঞ্চল।

যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে: ''activities inimical to the other and resolved not to allow their respective territory to be used for training, sanctuary and other operations by domestic or foreign terrorist/militant and insurgent organizations and their operatives''. অন্যদেশের ইনসারজেন্সি দমন করা বাংলাদেশের কর্তব্য? তার ওপর, লক্ষণীয় হচ্ছে, বিদ্রোহী সংগঠন বলেই থামছে না ইশতেহার, বলছে অপরাপর ‘‌‌কর্মকাণ্ড’ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট যে কেউ। এর আওতা এতটাই সীমানা ছাড়া ও লম্বা আছে যে ননকম্ব্যাটেন্ট বা যোদ্ধা ছাড়াও যে কোনো বেসামরিক সহমর্মী, সহানুভূতিসম্পন্ন লোক কিম্বা প্রাণভয়ে পালানো পরিবারের সদস্য অথবা আক্রান্তদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কিম্বা আক্রান্তদের পক্ষে জনমত তৈরিতে ব্যস্ত লোকেদেরও অনায়াসে এই ‘সন্ত্রাসে’র মধ্যে ফেলা যাবে। মানবাধিকার তো দূরে থাক, কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সর্বাত্মক শকুনে যুদ্ধ (অল আউট ওয়ার) চালানোর সাফসাফ ইশতেহার এটা। এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে বাংলাদেশের সক্ষমতা যাচাই করার কোনো দরকারই মনে করেন নাই শেখ হাসিনা। কি পরিমাণ ঝুকি থাকতে পারে এতে, সেটা নির্ধারণ করার কোনো আগ্রহও দেখান নাই। দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে তিনি এক ভয়াবহ আসন্ন যুদ্ধের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইভান্সের, অর্থাৎ পরাশক্তির কৌশলবিদদের তৈরি করা সমীকরণের দুই মাথার অংকটা শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে গিয়ে মিলিয়ে দিয়ে আসলেন। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একটা ব্যাপক মাত্রার মেরুকরণ আসন্ন; আর যুদ্ধ সম্ভবত শুরু হলো শেখ হাসিনার রাজি-খুশিতেই। উত্তর-পূর্বভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গলাটিপে ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। আর এত এত কাজে তার একমাত্র উপস্থিত পরামর্শক হলেন শ্রী নায়ার—দিল্লির সাউথব্লকই তার ভরসা।

অবশ্য নয়াদিল্লির সাউথব্লকের কর্তাব্যক্তিরা- ইনডিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সরকারও ইনডিয়াবাসীর জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনছেন এর মাধ্যমে। শুধু বাংলাদেশ না, বরং এই যুদ্ধে ইনডিয়ারও দুর্দশা পাকাপোক্ত হবে। অন্তত ইভান্সের মূল্যায়ন তো সেই ছবিই আঁকছে। সাতকন্যার অবস্থান থেকে বাংলাদেশ খুব একটা দূরে না। বাংলাদেশ যদি ইনডিয়ার হিংস্র থাবা ও নখর বিস্তারের জায়গা তৈরি করে দেয় তবে সাতকন্যার স্বাধীনতাকামীরাও এর বদলা নিতে বাংলাদেশের ওপর তাদের সমস্ত শক্তি খরচ করবে। খুঁজে নেবে আপন আপন মিত্রজোট। সেই দিকে এবার ফেরা যাক। পাকিস্তানের একজন সেনাকর্মকর্তা তার উপরওয়ালাকে, যাকে ডুয়ানে ইভান্স চিত্রিত করেছেন ঘটনাচক্রের একজন মূখ্য প্রযোজক হিসেবে, অপারেশনের শেষ মুহূর্তের খুটিনাটি জানাচ্ছেন। ``We have cordinated two indigenous insurgent groups. Within the next 12 hourse, they will begin to step up their operations here and here. Haq pointed to areas in Nagalnd and Manipur. ``I might mention that this is the first time that they have cooperated oparationally, and nither group is Islamic, they are ethnic minorities with long-standing grievancec against India’’।

দেখা যাচ্ছে, ফারাক্কার অপারেশনটি চালানো যখন, তখন এর সাথে একই সময়ে শামিল হবে ইনডিয়ান ইউনিয়নের থেকে স্বাধীনতাকামী দুটো বাহিনী, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরের। যারা কেউ নিশ্চয়ই ‘ইসলামী’ দল নয়। দীর্ঘদিনের দখলদারি ও বঞ্চনা তাদের ক্ষোভের কারণ, বিদ্রোহ তাদের দীর্ঘদিনের, কিন্তু এই প্রথম তারা পাশাপাশি এসে একসূত্রে একটা অপারেশনে কাজ করছে, সমন্বিতভাবে। যেটা আগে কখনো ঘটে নাই। এখানে বুঝতে হবে আলাদা করে ‘ইসলামী’ কথাটা বলার একটা কারণ আছে। একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সূচনা হয়েছে—ইসলামী একটা দলের অপারেশনের সাথে একযোগে যুক্ত হয়ে কাজ করছে ভারতের দুটি জাতীগোষ্ঠীর সংগঠন। সেই দলটির নাম লস্কর-ই-তাইয়েবা, এলইটি! এতদিন পরে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠার কারণ কি- সেটার কোনো ব্যাখ্যা ইভান্স দেন নাই। কিন্ত আমরা বুঝতে পারি; যে বই ইভান্স বের করেছেন তার সাবেক কর্মস্থল- সিআইএর অনুমোদন নিয়ে- তাদের পুরো কাহিনী দেখিয়ে- সেই বইয়ে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারেন না। সেই ‘বেশি কিছু’টা কি হতে পারে? আকলমন্দ কে লিয়ে ইশারাই কাফি! চীনকে যখন ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা সমানে চলছে, তখন চীনও নিশ্চয় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না।

তো, এলইটি যেই হামলার দায়িত্বে থাকবে সেটার লক্ষ্যস্থল ফারাক্কা ব্যারেজ কেন? তীক্ষ-পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ইভান্সের কাহিনীতে- এই অঞ্চলের সামগ্রিক সংঘাতের চরিত্র তিনি তুলে ধরেছেন নানা প্রতীকের মাধ্যমে। যেসব বিষয় পুরো সংঘাতের মধ্যে এখন কেন্দ্রে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে, তার একটা অবশ্যই ‘পানির বিরোধ’, অন্যতম প্রধান বিরোধ। ইনডিয়ার সাথে অভিন্নআন্তর্জাতিক নদীর পানিবন্টন নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘকালীন সমস্যায় আটকে আছে। যৌথ ৫৪টি নদীর উপরই ইনডিয়া কোনো না কোনো প্রকার বাধ বানিয়েছে- ব্যারাজ কিম্বা ড্যাম- কিম্বা সেচ প্রকল্পের নামে গায়ের জোরে পানি প্রত্যাহার করছে। সবমিলিয়ে পানি প্রত্যাহারের জন্য ইনডিয়ার গ্রহণ করা নানামুখি প্রকল্পগুলা সংঘাতের দিকে এই অঞ্চলকে ঠেলে দিচ্ছে, ক্রমাগত। সর্বশেষ টিপাইমুখ প্রকল্প- সম্ভাব্য সংঘাতের তীব্রতাকে আরো আরেক ধাপ ওপরে উঠিয়েছে। পানির পর্যাপ্ত ও যথাযথ প্রবাহ শুধু বাংলাদেশের কৃষি, প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষার জন্যই একান্ত আবশ্যক নয়, সাথে নদী বিধৌত পলিস্তরে গড়ে ওঠা ভূ-ভাগের অস্তিত্ব বজায় থাকার সম্পর্কও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু পানি, পানির স্বাভাবিক প্রবাহ দীর্ঘকাল অনুপস্থিত থাকলে- বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির প্রাণের বিকাশ-ধারা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সকল শর্তের উপস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে, যাচ্ছে।

কথা হলো; নিজের একার রাষ্ট্রীয় তৎপরতায়,আন্তর্জাতিক ফোরামে দেনদরবার করে, আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সমর্থন নিয়ে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করে, বাংলাদেশে কি সেই ‘শুকিয়ে মরা’র সম্ভাবনা ঠেকাতে পারবে? এমন কি ক্ষমতা বা শক্তির ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করতে পারে বাংলাদেশ, যাতে করে সে আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে নিজের ন্যায্য অধিকারটুকু আদায় করে আনতে পারবে? সেই প্রশ্নে কিছুটা এগিয়ে, সেই প্রশ্ন সামনে রেখে ইভান্স আভাস দিচ্ছেন; ইনডিয়ার একরোখা মনোভাব আর আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের অদূরদর্শিতার যোগফলে কেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এই অঞ্চলে। বাংলাদেশের নদীগুলা শুকিয়ে মেরে, পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে ইনডিয়া কোনোভাবেই নিজের নিরাপত্তা অক্ষুণ্ন রাখতে পারবেনা। কিভাবে ইনডিয়ান ইউনিয়নের নিরপাত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে, সেই ঘটনা পরম্পরা কিভাবে অগ্রসর হতে পারে, সেই ইশারা খানিকটা আমরা পেলাম নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা উপন্যাস থেকে।

যদিও ইভান্স সমাপ্তি টেনেছেন এইভাবে যে, খোদ আইএসআই অফিসার মেজর তারেক দুররানির জীবনবাজি প্রচেষ্টায় শেষ মুহূর্তে বানচাল হয়ে যায় অপারেশন ফারাক্কা। কিন্তু সে চেষ্টা একবার ব্যর্থ হলেই কি থেমে যাবে? তাছাড়া, শুধু তো গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেই আর বিষয়টি সীমিত নাই। এই যেমন সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে ফিলিপ বাওরিং লিখেছেন- ‘India's opening with Bangladesh’, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একজন ভাষ্যকার ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক হচ্ছেন বাউরিং। এবছরের বারোই জানুয়ারি প্রকাশিত লেখায় বাউরিং বলছেন, ইনডিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি, সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ কিংবা ট্রানজিটের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ইস্যু হচ্ছে পানি। ইনডিয়া যেভাবে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করছে, তাতে করে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়া খুবই ‘সঙ্গত’,, পানি বাংলাদেশের প্রাণরক্ষার জন্য ‘রক্ত সঞ্চালন’র মতো। অভিন্ন নদ-নদীসমূহের পানি পাওয়া না পাওয়া আর বাংলাদেশের টিকে থাকা না থাকা, জনগণের বাঁচা-মরা একই সূত্রে গাথা। এটা অনিবার্যভাবে সম্পর্কিত। তবু বাংলাদেশকে মরুভূমি বানাবার পথ ছেড়ে সরে আসছে না ভারত। তাহলে, যে কাঁটায় জলপ্রবাহের শরীর আর বাংলাদেশের প্রাণ ক্ষতবিক্ষত করে তুলছে সেটা সরাবে কে? ইভান্স যে ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেদিকেই কি এগুতে থাকবে অবশেষে!


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।