জলযুদ্ধ: পানি আগ্রাসনের মুখে জীবনের আখ্যান-নাটক


ওয়াহিদ সুজন
Thursday 19 November 09

Water is Life Water is Right এই শ্লোগান নিয়ে সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্টিত হলো কারিগরের দ্বিতীয় প্রযোজনা “জলযুদ্ধ”র প্রথম প্রর্দশনী।

পানিকেন্দ্রিক যে সমস্যার ভেতর দিয়ে আজ আমরা যাচ্ছি তাকে সার্বজনীন পরিমন্ডলে উপস্থাপনের শৈল্পিক প্রক্রিয়া বলা যায় একে। কারিগর নিশ্চিত দায় অনুভবের স্থান থেকে এই প্রযোজনাটি করেছে। তাদের ভাষায়, “ পানির অপর নাম জীবন। তারপরও পানি নিয়ে বিভিন্ন নগ্ন রাজনীতি ও অপরাধ সংগঠিত হয়ে আসছে পৃথিবীর শুরুকাল থেকেই। পৃথিবীতে নানা সভ্যতা যেমন গড়ে উঠেছে নদীর কিনারে তেমনি পানির জন্যই ঘটেছে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বেচে থাকার জন্য, সুন্দর সবুজ থাকার জন্য মানব জাতি জলকে পবিত্র জ্ঞান করে আসছে আদিকাল থেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন পানির জন্যই ঘটতে পারে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ”।

ইতিহাস গল্প আর মিথকে একই সমান্তরালে দাঁড়করিয়ে জলযুদ্ধের কাহিনী। শুরু হয় আমাদের জ্ঞাত ইতিহাসের এক মর্মান্তিক কাহিনী কারবালার যুদ্ধ দিয়ে। হোসেনের কাফেলায় পানির সংকট। বৃদ্ধ, যুবা, নারী, শিশু সকলে পিপাসায় কাতর। ইমাম হোসেনের দুই সৈন্য পানির খোঁজে বের হয়। ফোরাতের তীরে এসে দেখে এজিদের সৈন্যরা পাহারায়, তারা কাউকে পানি নিতে দেবে না। একজন দয়াপরবশ হয়ে সৈন্যদের পানি পানের প্রস্তাব দিলে তারা এই বলে প্রত্যাখ্যান করে, যেখানে তাদের শিবিরের অন্যরা পিপাসার্ত, সেখানে নিজেদের পিপাসা তুচ্ছ বিষয়...

এরপর দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয় তিস্তা পারের দুই কিশোর। উমর ও নসু। যারা দুজনেই বাসন্তীর প্রেমে পড়েছে। তাদের হাসি আনন্দ দুঃখ যাতনা সকলেরই স্বাক্ষী এই নদী। নদী তাদের দিয়েছে অফুরন্ত জীবনী শক্তি।

এভাবে একের পর এক দৃশ্যান্তরে আসে মৃতের জেগে উঠা, নদীতে জেগে উঠা চর, নদী-ভাঙ্গন, চর দখল নিয়ে বিবাদ, নদী কি করে তার স্বাধীনতা হারায়, নদীর শুকিয়ে যাওয়া, কিভাবে নদী বোতল বন্দী হয়ে সাধারণের ধরা ছোয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে।

নাটকের আকর্ষণীয় একটি অংশ হলো শীতলক্ষ্যা ও ব্রক্ষ্মপুত্রের প্রেমলীলা। লোককাহিনী হতে নেয়া অংশটিতে প্রতীকায়নের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে নদীকে মানুষ কেমন করে নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নিয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির নিত্য ও অনিত্য সম্পর্কের অনুধাবন কেমন মানবিক রূপরসে পুষ্ট আখ্যান হিসেবে জনমানসের অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি হয়ে চৈতন্যে নিরন্তর বহমান। আর এই প্রায় শ্বাশতকি সম্পর্কের মাঝে, জীবন ও জগতের পূর্বাপর ধারাবাহিকতার মাঝে আমরা কত ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। যে শীতলক্ষ্যা ও ব্রক্ষ্মপুত্রের প্রেমলীলার আবেশে আমরা শিহরিত; যার প্রবাহে প্রাণের জাগরণ, সৃষ্টি, সবুজ ও সভ্যতা এখন ঠিক তাকে দেখেই মন ঢুকরে কেঁদে উঠে। তাদের মৃত জীর্ন র্শীর্ণ আবয়ব দেখে হাহাকার আর কারবালার জিঘাংসাপরায়ণ পুনরাবৃত্তির দৃশ্যাবলী ভেসে আসে। পানি, আহা! যা কিনা জীবনের উৎস, তাকেই বানিয়েছে মারণাস্ত্র।

নাটকের শেষাংশে উপস্থিত হই আমাদের ইতিহাসের এক অনন্য অভিজ্ঞতায়। একজন শশ্রুমন্ডিত বৃদ্ধ লংমার্চ নিয়ে ফারাক্কা বাধের প্রতিবাদে গর্জে উঠেন। তিনি তার কেউ নন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মঞ্চের অভিনেতাদের চোখ দিয়েই দেখি ঐ তো ভাসানী হেটে যাচ্ছেন। আমাদের লজ্জা পাওয়া ছাড়া কিছুই কি করার থাকে। যদি কিছু থাকে প্রেরণার আর ভুল শুধরে নেবার...

এই নাটকটি সম্পর্কে কারিগরের ভাষ্য,“... নাটকটি নদীর গতির মতো। একটি মাত্র কাহিনী নয়, জীবন ও নদীর পাড়ে পাড়ে যেমন প্রতি মুহুর্তে অনেক ঘটনা ঘটে যায় ঠিক তেমনি নাটকের বাকে বাকে অনেক ঘটনা ও মুহুর্ত দৃশ্যায়ন করা হয় যা এখনকার মানুষের জীবন যাপনে প্রকাশিত অথবা অপ্রকাশিত সত্য। নদীরও ভাষা আছে, মানবসৃষ্ট উৎপীড়নে অতিষ্ট নদীও কাঁদে”।

পৃথিবীতে ২৬১টি নদী অববাহিকা রয়েছে যা দুই বা ততোধিক রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করেছে এবং প্রায় ১৪৫টি দেশ এসব নদীর উপর কমবেশী নির্ভরশীল। এইসব নদীর পানি নিয়ে নদী তীরবর্তী দেশগুলোতে আছে নানা বিবাদ। যেসব দেশ উজানের দিকে থাকে, তারা চায় নদীর উপর একছত্র নিয়ন্ত্রণ। সেচের জন্য বাধ, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানা স্থাপনা গড়ে তোলে। আবার এর সাথে শক্তির বিষয় জড়িত। বাংলাদেশের সাথে ভারতের ৫৪টি এবং মায়ানমারের সাথে ৩টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের প্রায় ৪৭টিতে রয়েছে বাধসহ নানাধরণের স্থাপনা। এইসব কর্মের সারমর্ম হলো উজানের দেশ বাংলাদেশ তার নদী হারাচ্ছে। বর্তমানের অন্যতম আলোচিত ঘটনা টিপাইমুখ বাধ হলে শুধু বাংলাদেশেরই নয় ভারতের জনগোষ্ঠীর একটি অংশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মজার বিষয় হলো, আমাদের রাজনীতিবিদ’রা এই বিষয়ে চুপ। এক কদম এগিয়ে কেউ কেউ বলছেন, এই বাধ আমাদের উপকারে আসবে। অপরদিকে, তিব্বতে চীন যখন ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উপর বাধ দিচ্ছে ভারত তার প্রতিবাদে সোচ্চার। পরিহাস বটে...।

কারিগরের সামাজিক লক্ষ্য, উদ্দেশ্য আছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তা তারা কর্মে দেখতে চায়। দেশকে মাতৃভূমি বলা হয়। মা মাটি দেশ একাকার হয়ে আছে। এটি আবেগ নয়, এখানকার বাস্তব জীবন চিত্র। মানুষের সাথে প্রকৃতির যে সম্পর্ক তাতে নদীর সাথে মানুষের জন্ম ও বেচে থাকার সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক। মানুষ তার জীবনকে নদীর সাথে তুলনা করে। মানুষের মহৎ সাধনাগুলো নদীর সাথেই জড়িত। মানুষের দৈনন্দিনতা সৃজন সকল স্থানে নদীর উপস্থিতি আছে। এবং নদীর যে দান তার সাথে তুলনা চলে না অন্যকিছুর, এটি খুবই প্রত্যক্ষ। মানুষের মানুষ হয়ে উঠার পেছনে আছে নদীর অফুরন্ত দান। সেই প্রাচীনকাল থেকে নদী হয়েছে মানুষের ঠিকানা।

কারিগরের চেতনা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ নয় বরং নাটকে তার প্রতিফলন ঠুনকো পিঠ বাচানো বুদ্ধিবৃত্তিক সুশীলতাকে ছাড়িয়ে গেছে। জলের সাথে জীব ও জীবনের অস্তিত্বের সম্পর্ককে তারা প্রাচ্যের জ্ঞানকান্ডের আদলেই ব্যাখ্যা করেছেন। মানব জীবন এবং নদী তথা প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক বিচারে প্রাচ্যের আচরণ অধিক প্রাণবন্ত এবং মানবিক তৎপরতায় ভরপুর। হা/না নির্ভর লজিক অথবা শুধুমাত্র উপযোগ চিন্তার বিপরীতে এখানে সম্মিলিন ঘটেছে প্রকৃতির [যেখানে আপন পর ভেদ বিরল] সামগ্রিক চেতনা। যা শুধুমাত্র কি করলে কি হবে তা নয়, বরং সম্পর্কের আধ্যাতিক দ্যোতনায় ভরপুর। এর বিরুদ্ধাচরণ করা মানে নিজেকে অস্বীকার করা, নিজেকে খন্ডিতভাবে বুঝা, দেখা এবং পা থাকার চেয়ে ক্রাচকে উত্তম মনে করা। একই ঘটনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সকল স্থানে সত্য। মানুষের যে সার্বিক ধারণা অথবা মানবতাবোধ তাকে প্রকৃতির’ চে অনবদ্যভাবে আর কে বুঝাতে পারে?

“ঝরণায়, নদীতে স্ফটিক-স্বচ্ছ যে জল গড়িয়ে যায় সে তো নেহায়েত জল নয়, আমাদের প্রপিতাদের স্বেদ, রক্ত।... নদী আমাদেও ভাই। তাদের জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটে। ওরা আমাদের নৌকা বয়ে নেয়, আমাদের সন্তানদের মুখে গ্রাস জোগায়। অতএব আপনি অবশ্যই অবশ্যই নদীকে সেই রকম দয়াদাক্ষিণ্য করবেন যেমনটি করবেন আপনার ভাইকে।” [সুত্র- যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে লেখা রেড ইন্ডিয়ান সর্দার সিয়াটলের চিঠি: পাওয়ার অফ মিথ, জোসেফ ক্যাম্পবেল]

আমাদের মতো দেশে সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের স্বার্থের বিপরীতে বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবি’রা নিমর্ম তোষণনীতিকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ- তারা দূষণমুক্ত বুড়িগঙ্গার [আন্দোলনের নায্যতা নিয়ে নয়] জন্য প্রাণদানে কুন্ঠাবোধ [?] করবে না অথচ পদ্মা, তিস্তা, মেঘনা শুকিয়ে গেলে চুপ থাকে। অথবা যেখানে নদীই থাকছে না, সেখানে জনগণকে নদীতে ডেজিং’র স্বপ্ন দেখানো হয়, সেলুকাস। কর্পোরেট নৈতিকতার যুগে দাতাগোষ্ঠীর দান ও উন্নয়ন নীতিই ঠিক করে দেয় কোনটি হবে অথবা হবে না, কোনটি প্রতিবাদযোগ্য আর কোনটি নয়।

সহজবোধ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনা ও সংলাপ পরম্পরা এই নাটককে আত্মার কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। নাটকটি রচনা ও নির্মাণ করেছেন সরকার হায়দার। শিল্পময় ও কুশলী কাজটির জন্য তিনি সাধুবাদ পাবার যোগ্য। নদী নিয়ে সম্ভবত এখানে এমন কাজ আর হয় নি। এটি বাংলাদেশের নাট্য ইতিহাসে নানাদিক থেকেই উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচিত হবে বলে অন্তত আমার বিশ্বাস। তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ এই জন্য যে তিনি অতি শিল্পিত করতে গিয়ে নাটকটিকে বিমূর্ত করে ফেলেন নি। এটি মূর্ত বিবরণ এবং আমাদেরই জীবন ঘনিষ্ঠ।

উত্তর বঙ্গের পালাটিয়া রীতিতে নাটকটি উপস্থাপন করা হয়েছে। দুজন মাত্র অভিনেতা আসিফ মিল্টন এবং সাত্তার হিরা [বয়সে নবীন] সবগুলো চরিত্র ধারণ করেছেন। জটিল উপস্থাপনাও বটে, তবে সংযত ও সতেজ। কিছু কিছু জড়তা থাকলেও তাদের অভিনয় মুগ্ধ করার মতো [বাহুল্যহীনতা]। যেহেতু বিরতিহীন দীর্ঘ অভিনয় এবং সংলাপ মুখস্ত রাখতে হয়, তাই রিহার্সেলের গুরুত্ব বেশি। মোটের উপর এটা ছিলো তাদের প্রথম প্রদর্শনী।

বাহুল্যহীন সাদামাটা সেটে নাটকটি মঞ্চায়ীত হয়েছে। এই নাটকে সাদামাটা সেটই যথেষ্ট। তারপরও নাটকে মেজাজের জন্য মানানসই সেটের অবশ্য দরকার, তাহলে দৃশ্যের সাথে চোখ সহজে একাত্ম হতে পারে। তারপর নাটকের দৃশান্তরে সেট ও আলোক প্রক্ষেপনের আরো কোন ভূমিকা আছে কিনা তাও ভেবে দেখতে বলব। যেহেতু মাত্র দুজন অভিনেতা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, এই বিষয়টি তাদের জন্য কারিগরী সহায়তা দিতে পারে। এই নাটকে আলোক প্রক্ষেপন বিভিন্ন স্থানে খাপছাড়া মনে হয়। বিশেষ করে চম্বুক মুহুর্তগুলোতে অভিনেতাদের ফোকাস করা এবং দৃশ্যান্তরে আলোক প্রক্ষেপন আরেকটু সুক্ষ হওয়া দরকার। আরেকটু যত্মশীল হলে তা কাটিয়ে উঠা যায়।

মিউজিক স্কোর প্রচলিত, একেবারেই মৌলিক নয়। দুই বা তিনটি গীত নাটকে কাজে লাগিয়েছেন। বিষয়ানুযায়ী ঠিক আছে। শুধুমাত্র সংগীতের ব্যবহারে সময়ের হের-ফেরে মনোযোগী হলে ভালো।

এরমধ্যে [নভেম্বর মাসে] নাটকটির মোট দুটি প্রদর্শনী হলো। সম্ভবত, ডিসেম্বর মাসে কারিগর এই নাটক নিয়ে আবার হাজির হবে। তাদের জন্য শুভ কামনা। বিষয় ও গুরুত্বের দিক হতে, সর্বোপরি একটি ভালো প্রযোজনা হিসেবে এর বেশী বেশী প্রর্দশন এবং একে জনপরিসরে উপস্থাপন করা যায় কিনা সে বিবেচনার অনুরোধ রইল।

View: 4900 Posts: 2 Post comments

লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো। আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া আপনার দায়িত্বানভূতির জন্য। যথেষ্ঠ অভিনিবেশ সহকারে নাটকটি দেখেছেন বলে মনে হয়। ধারাবয়ানটি খুবই চমৎকার হয়েছে। আবারো শুকরিয়া।

thanks

ধন্যবাদ ওয়াহিদ সুজন জলযুদ্ধের বিশ্লেষনের জন্য। না ! ডিসেম্বরে প্রদশর্নী করতে পারছিনা বিশেষ কিছু জটিলতায়। বাংলা নাটক এই জটিলতা কে বহন করে আসছে অনেকদিন । আশা করছি জানুয়ারী তে আবার ...পারব, সাথে আপনার সাজেশন সহ।
Home
EMAIL
PASSWORD