দারুণ রায়! দারুণ বৈচারিক প্রতিভা!


“আমি হচ্ছি ভাঙা কুলা। পঞ্চম সংশোধনী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ সংশোধনী পর্যন্ত সবগুলো রায়ই আমাকে দিতে হয়েছে” - সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, মানবজমিন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিচার করে বিদ্যমান গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণের রাজনৈতিক শক্তি বিকাশের রাজনীতি কী হতে পারে তার নীতি ও কৌশল নির্ধারণই এখন বাংলাদেশের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সেই দিকে নজর রেখে কয়েক কিস্তিতে লেখা শুরু করেছিলাম, প্রথম লেখা ছিল ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আঞ্চলিক উত্তাপ’ (এখানে দেখুন) । তবে অনিবার্য কারনে লেখার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। পাঠকের কাছে মাফ চেয়ে আবার শুরু করছি।

আভ্যন্তরীণ বাস্তবতা যতোটা নয়, তার চেয়ে আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বেশি নির্ধারক ভূমিকা রাখবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। এই প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম। কথা বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে দেশের ভেতরে বেশ কিছু নতুন বিষয় সামনে চলে এসেছে। যেমন, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়। এই রায় আগামি নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি প্রাসঙ্গিক। গত বছর ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়। সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় দিয়েছিল। সংক্ষিপ্ত রায় একই সঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করে পরবর্তী দুটি নির্বাচন হতে পারে বলেও অভিমত দেয়। – অর্থাৎ আদালত বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম ও একাদশ সংসদের নির্বাচন হতে পারে।

সংক্ষিপ্ত আদেশে বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন, ১৯৯৬ (আইন-১: ১৯৯৬) ভবিষ্যতের জন্য ‘বাতিল’ (void) করা হয় এবং এই সংশোধনী ‘সাংবিধানিক কর্তৃত্ব বহির্ভূত’ (ultra vires) হয়েছিল বলে ঘোষণা করা হয়। ultra vires একটি ল্যাটিন পদ, যার অর্থ দাঁড়ায় যারা সংবিধান সংশোধন করেছেন তাদের এটা করবার কোন আইনী বা সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ছিল না। ইংরাজিতে দেওয়া রায়ের ভাষা ছিল এরকমঃ The Constitution (Thirteenth amendement) Act, 1996 (Act 1 of 1996) is prospectively declared void and ultra vires the Constitution। সংবিধান সংশোধন করেছে জাতীয় সংসদ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদকে যে ক্ষমতা দিয়েছে সেই ক্ষমতা শুধু আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা নয় (legislative power), একই সঙ্গে সংবিধান বদলে দেবার বা সংবিধান প্রণয়ণী ক্ষমতা (constitutive power)। আদালত এই ধরনের ক্ষমতা আদৌ জাতীয় সংসদের থাকা উচিত কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন করে নি, বা গণতন্ত্রের এই গোড়ার প্রশ্ন তোলার ক্ষেত্রে বিরত থেকেছে, কিন্তু এই সংশোধনী রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ করেছে বলে বাতিল করেছে।

গণ মাধ্যমগুলো ultra vires –এর অনুবাদ করে থাকে ‘সংবিধান লংঘন’ বা ‘অসাংবিধানিক’। এতে অসুবিধা নাই তবে এই অনুবাদে আইনী বা সাংবিধানিক কর্তৃত্ব সংক্রান্ত গুরুত্ব পূর্ণ ধারণা আড়াল হয়ে যাবার আশংকা তৈরী হয়। যেমন, আদালত যে কর্তৃত্বের বলে এই সংশোধনী বাতিল করলেন সেই কর্তৃত্ব বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আদৌ আদালতের আছে কিনা গোড়ার সেই প্রশ্নটা এতে অস্পষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া আরেকটি প্রশ্নও আড়াল হয়ে যায়ঃ রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা আদালতের করা উচিত কিনা। শেষের প্রশ্নটি নিছকই আইনী প্রশ্ন নয়, রাজনীতিরও প্রশ্ন। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায় আদালত এই কুকর্ম করলে নিজের ঘাড়েই বিপদ ডেকে আনে এবং কার্যত আদালত নিজেই নিজেকে রাজনীতির ময়দানে পরিণত করে।

রায় লেখার পর বিচারপতি খায়রুল হক গত ২৮ মার্চ তা সুপ্রিম কোর্টে জমা দেন। এর ওপর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেন অপর বিচারপতিরা। মতামতসহ রায়টি গত ১১ সেপ্টেম্বর ইতোমধ্যে অবসর নেওয়া বিচারপতি খায়রুল হকের কাছে পাঠানো হয়। পত্রিকার খবর অনুযায়ী তিনি নীল কাগজে প্রিন্ট নেওয়া ৩৪২ পৃষ্ঠার রায়ে সই করেন (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২) ।

ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত পূর্ণ রায় এখন প্রকাশিত হয়েছে। ঢাউস জিনিস। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে এমন এক ভাব করছে যে এই রায়ই আগামি দিনের রাজনীতি নির্ধারণ করে দেবে। এই ফালতু ধারণাকে নাকচ করা দরকার। রাজনীতি আদালত বা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তবে ক্ষমতাসীন দল আদালত ও বিচারকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার কারণে রায়ের ভাষা ও তার অন্তর্নিহিত তত্ত্বের কী দশা ঘটে সেটা বোঝার জন্য রায়টি ভাল নজির। তবে কোন ধরণের অ্যাকাডেমিক আলোচনা এখন সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।

বাংলাদেশে এখন জনগণের প্রধান কর্তব্য বিদ্যমান রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটিয়ে গণতন্ত্র কায়েম। নতুন রাষ্ট্র গঠন ও কায়েম করা। গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরণ। নির্বাচন বা ভোটাভুটির মাধ্যমে সরকার গঠনকে রাষ্ট্র গঠন বলে না। রাষ্ট্র গঠন সম্পূর্ণ আলাদা একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা ক্ষমতাবান তারা এই রূপান্তর চায় না, চাইতে পারে না। ক্ষমতাবানদের বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিদ্যমান রাষ্ট্র বহাল রেখে নিজেদের মধ্যে কে আগামি পাঁচ বছর জনগণকে শাসন ও শোষণ করবে তা নির্ধারণ করাই একমাত্র ‘রাজনৈতিক’ (?) বিতর্ক। এই তর্ক থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের দিক থেকে বিতর্কের গোড়ার বিষয়গুলো ধরতে পারা জরুরি কাজ। যেমন, কিভাবে বিদ্যমান রাষ্ট্র জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করছে এবং কেন গণতন্ত্রের অর্থ হয়ে আছে এমন একটি রাষ্ট্রের ধরণ যেখানে জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কুক্ষিগত। অথচ গণতন্ত্রে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার ক্ষমতা জনগণ রাষ্ট্রকে দেয় না। দিতে পারে না। বাংলাদেশে জনগণের রাজনৈতিক শক্তি বিকাশের কর্তব্য মনে রাখলে এই গোড়ার বিষয় ধরতে পারার সামর্থ্য অর্জন প্রাথমিক, কিন্তু অতিশয় জরুরি একটি কাজ। সেই কথা মনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আদালতের রায় নিয়ে যে বিতর্ক চলছে সেই কথা মনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত আদালতের যে তায় চলছে তা নিয়ে দুই একটি বিষয় নিয়ে আজ আলোচনা করব।

রায়কে কেন্দ্র করে তর্কের ধরন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিতর্ক যেভাবে চলছে তাতে এর রাজনৈতিক মর্ম যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা হোল নির্বাচনে নিজ নিজ দলের পক্ষে সুবিধা আদায়ের সংগ্রাম। এর অধিক কিছু নয়। সেই দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিতর্ক নিছকই ‘দলীয়’ বিতর্ক, বিতর্কের ধরণও দলবাজিতার বা দলসর্বস্বতার বাইরে যেতে পারে নি। ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত পূর্ণ রায় প্রকাশিত হবার পর যেসব তর্কবিতর্ক দেখছি সেই সবও দলীয় পরিমণ্ডলের সীমার মধ্যেই খাবি খাচ্ছে। রাজনৈতিক,আইনি বা তাত্ত্বিক কোন দিক থেকেই এই তর্কগুলো আমাদের নতুন ভাবে ভাবতে সহায়তা করে না।

ছোট বা সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছে আগামি দুই দফা অনির্বাচিতদের দিয়ে পুরানা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু পূর্ণ রায়ে আবার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করবার কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রি হাসিনার সর্বশেষ ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হলে কিন্তু কোন মন্ত্রি বা সংসদ সদস্য আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকেন না। তাহলে পূর্ণ রায় অনুসারে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়তে গেলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কোথায় পাওয়া যাবে? তর্কটা দাঁড়াচ্ছে শেখ হাসিনার কথা মতো অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ছোট মন্ত্রিসভার অধীনে নির্বাচন হবে, নাকি হবে পুরানা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে? বুঝি, সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়ই বাংলাদেশে কিভাবে আগামি দিনে নির্বাচন হবে তা ঠিক করে দেবে! রায়কে কেন্দ্র করে তর্কগুলো কিভাবে নির্বাচন হবে শুধু সেই জায়গাতেই এই ভাবে খাবি খাচ্ছে।

নিজ দলের স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়া অবশ্য এই সব আইনি তামাশাকে ধমক দিতে দেরি করেন নি। অনেকের অভিযোগ সাবেক বিচারপতি শেখ হাসিনাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সংক্ষিপ্ত রায় আর পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে সঙ্গতি রাখবার ন্যূনতম বিবেচনাও হারিয়ে ফেলেছেন। হতে পারে। তবে আইনি দিক থেকে এই দৃশ্যমান অসঙ্গতিকে ভিন্ন ভাবে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেটা হোল, এ বি এম খায়রুল হক কি একই মামলার দুইটা রায় দিয়েছেন? একটি তিনি অবসরে যাবার আগে, পরেরটি অবসরে গিয়ে? নাকি দুটো মিলেই একটা রায়। যদি দুটো মিলে একটি রায়ই হয় তাহলে রায়ে অসঙ্গতি সমস্যার কথা আর কি বলব! কিছুই না! রায় অনুযায়ী পুরানা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে, আবার দুই দল থেকে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠন করা ছোট মন্ত্রী সভা দিয়েও নির্বাচন করা সম্ভব। দুটোই সম্ভব। রায়ে দুই পরামর্শই আছে। আসলেই।

দারুণ রায়! দারুণ বৈচারিক প্রতিভা!

রাজনৈতিক বিষয়কে আইনী তর্কে পর্যবসিত করা হোল

এই ধরণের অসঙ্গতি বিচারপতি ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের আস্থা বাড়াবে না, বরং কমাবে। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হকের অবস্থানকে অধিক গুরুত্ব দেবার জন্য এই তর্কটা গণমাধ্যমে প্রধান করে আনা হচ্ছে। অথচ আগে দেওয়া ছোট রায়ই বেঞ্চের সমস্ত বিচারপতিদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। পূর্ণ রায়ে আমরা বিভিন্ন বিচারপতির ব্যক্তিগত অবস্থান দেখি। সম্মিলিত রায়ই আদালতের রায় আর পূর্ণ রায়ে বিচারপতিদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে আমরা বিষয়টিকে বিভিন্ন দিক থেকে পর্যালোচনা করতে পারি মাত্র। কিন্তু এটা বলতে পারি না যে শেখ হাসিনার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ছোট মন্ত্রী সভার অধীনে নির্বাচনের পরামর্শই আদালতের সম্মিলিত পরামর্শ। সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সম্পর্কে নতুন করে বলবার কিছু নাই, কিন্তু পূর্ণ রায় দেখে বোঝা যায় সব বিচারক রাজনৈতিক দলের হুকুমদারিতে চলেন না।

আসলে পূর্ণ রায় সংক্ষিপ্ত রায়ের তুলনায় আইনী দিক থেকে দিক থেকে নতুন কোন বিতর্ক তৈরি করে নি। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হলেও আগামি দুইটা সংসদীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এটাই সম্মিলিত রায়। রায়ে বিচারপতিদের ভিন্ন ভিন্ন মতকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে গুরুত্ব দিয়ে তর্ক তোলা নিরর্থকই বটে।

তবে জনগণের দিক থেকে ইন্টারেস্টিং দিক হোল কিভাবে ক্ষমতাসীনরা আদালতের সহযোগিতায় এই তর্ককে একটি ‘আইনি’ তর্কে পর্যবসিত করল। তাদের দাবি, যেহেতু আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে অতএব তাদের কিছুই করার নাই। ক্ষমতাসীনরা তাহলে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখতে চায় কেন? তারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই সরাসরি আইন পাস করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু করলেন না কেন তারা? বোঝা মুশকিল। তবে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তাব হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার মূলত আওয়ামী লীগেরই আন্দোলনের ফল। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলেছিল তারা, আন্দোলন-সংগ্রাম করে এই দাবি তারা আদায় করে ছেড়েছিল।

কিন্তু এখন ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায়, ক্ষমতায় এসেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা জরুরি মনে করেছেন। তাঁর সাধ ক্ষমতায় থেকেই তিনি আগামি নির্বাচন করবেন। কিন্তু এখন কোন মুখে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করবে? অতএব নিজেরা তত্ত্বাবধায়কের বিরোধিতা না করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি ছোঁড়া হোল। সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সানন্দে কাঁধ দিলেন। আওয়ামী লীগ এখন বলতে পারছে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একসময় চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখন আদালত তা অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে দিয়েছে। আদালত মান্য। এ ক্ষেত্র আওয়ামী লীগের কোন হাত নাই।

পাল্টা বিরোধী পক্ষ বলছে আদালত কী রায় দিল তাতে কিছু আসে যায় না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না। বেগম জিয়া ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে দিনাজপুরের সভায় বলেছেন, গত নির্বাচনের সময় ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন জুটেছিল। এখন আরেক সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে দিয়ে আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত রায়ের ষোল মাস পর একটা মন মতো রায় লিখিয়ে নিয়েছে। আরো বলেছেন, “আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যে ভাষায় কথা বলেন, সে ভাষায় রায় লিখে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে ছোট মন্ত্রিসভা করে নির্বাচন করার জন্য বলেছেন তিনি”। এই রায় অতএব মানবার প্রশ্নই ওঠে না।

ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত রায় যে আসলেই দলীয় রায় বেগম খালেদা জিয়ার এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করা কঠিন। কঠোর আন্দোলন আসছে বলেও খালেদা জিয়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এটা মনে করিয়ে দেবার দরকার নাই যে শুরুতে যখন প্রস্তাব আসে বিএনপি এই ধরণের সরকার ব্যবস্থার বিরোধিতাই করেছে। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে বিএনপি নির্বাচন করতে চায় না, কারণ আশংকা এতে তার জিতবার সম্ভাবনা কম। অতএব তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, এটাই বিএনপির দাবি। এই হোল অবস্থা।

এটা পরিষ্কার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মোটেও একটি আইনি তর্ক নয়, কখনোই ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই এই ব্যবস্থা বিবদমান দলগুলো নিজেদের মধ্যে একটা মীমাংসা হিশাবে মেনে নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে এই ব্যবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ কি না সেটাও আইনি তর্কের বিষয় নয়, রাজনৈতিক বিষয়। মনে রাখতে হবে ১৯৯১ সালে প্রথমবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জনগণ যতটা নিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি গ্রহণ করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই। আর আমরা আগেই বলেছি, এই দলগুলো গণতান্ত্রিক নয়। এ কথাটা বলছি রাজনৈতিক বিচারে, আইনি তর্কের জন্য না। এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তার রাজনৈতিক বিচার দলগুলো তখন করে নি। বিচার করবার দরকারও তারা মনে করে নি। কিন্তু স্মরণ করিয়ে দেই, এরশাদ ক্ষমতাসীন থাকার সময় তার বিরুদ্ধে যেসব দল একাট্টা হয়েছিল, তারা এরশাদকে সরিয়ে দিয়ে কিভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্ন নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করবে তারই একটি ফর্মুলা হিশাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সকলে একমত হয়েছিল।

রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানগত সমীকরণ এখন বদলে গিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে তাদের বিরোধও প্রকট হয়েছে। কেউ আন্দোলন করে তা বহাল রাখতে চাইছে, আর কেউ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তা বাতিল করে ভাবছে, এতে প্রতিপক্ষকে দুর্বল অবস্থানে ভালোভাবেই ঠেলে দেওয়া গেল। মনে রাখতে হবে ২০০৬ সালে মওদুদ আহমেদও বিচারকের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে বিএনপির পক্ষে এমনই একটা সুবিধা বের করে নিতে চেয়েছিলেন। এবার আওয়ামী লীগ সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে বলির পাঁঠার মতো সামনে এগিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিতে পারবে ভাবছে। সাবেক বিচারপতি তাঁর এই ভূমিকা সানন্দে মেনেও নিলেন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে থাকবেন, সন্দেহ নাই। বিচার বিভাগকে অতিশয় নগ্ন ভাবে ক্ষমতাসীন দলের অতি সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবার যে নজির তিনি সৃষ্টি করলেন তার তুলনা হয় না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, কিন্তু জনগণের সমর্থন থাকুক বা না থাকুক বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনেই রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে এবং জাতীয় সংসদে সংশোধনী এনে তা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার ন্যায্যতা সরাসরি সংবিধান সংশোধন বা আইনের দ্বারা কায়েম করা হয় নি, বরং রাজনীতির দ্বারা আগেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে এই ন্যায্যতা তৈরি, সন্দেহ নাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ন্যায্য নাকি অন্যায্য, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নাকি নয় ইত্যাদিকে আদালতের বিষয়ে পরিণত করলে, আদালতকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে টেনে আনা হয়। কিছু কিছু বিচারপতি সোৎসাহে এই কাজ করে চলেছেন। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক-সংক্রান্ত রাজনৈতিক ধারণা জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়ে সাংবিধানিক ন্যায্যতা লাভ করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এই আইনকে বাতিল করবার এখতিয়ার আদৌ আদালতের আছে কিনা, কিম্বা থাকলেও এই এখতিয়ার আদালতের থাকা বাঞ্ছনীয় কিনা সেটাই হচ্ছে তর্কের বিষয়।

সংশোধনীসহ সংবিধান রক্ষা করবার শপথ নিয়ে সংবিধান বাতিল !

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা যদি নিছকই অগণতান্ত্রিক ক্ষমতাবান শক্তি ও শ্রেণির নিজেদের মধ্যে ‘রাজনৈতিক’ মীমাংসা হয়ে থাকে, তাহলে কি তার কোন সাংবিধানিক বা আইনি মর্ম নাই? অবশ্যই আছে। আমরা জানি, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংসদে সংবিধানের সংশোধনী হিশাবে গৃহীত হয়েছে। অতএব তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ। এ বি এম খায়রুল হক যখন বিচারপতি হিশাবে শপথ নিয়েছিলেন, তখন তিনি এই সংবিধান রক্ষা করবেন বলেই শপথ নিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি হিশাবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি শপথ নিয়েছিলেন, “আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব” (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় তফসিল দেখুন)। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধান রক্ষা করবেন বলে শপথ নিয়ে যিনি বিচারপতি হয়েছেন তিনি সেই সংবিধানের কোন সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করতে পারেন কি না? ‘সংবিধান ও আইনের রক্ষা, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ করবার কর্তব্যের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক কি না। এই প্রশ্নটির গুরুত্ব অসামান্য। কারণ এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে বিচারপতিরা সংবিধানের অধীন, নাকি অধীন নন সেই প্রশ্ন তুলবার ও মীমাংসার পথ খোলাসা হতে পারে। কিন্তু সংবিধান ও আইনের অতি গোড়ার এই প্রশ্নটিকেই সংবিধান সংশোধনী-সংক্রান্ত বিতর্কগুলোতে বিস্ময়কর ভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত বিতর্কের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি।

বিচারপতিরা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নী সংস্থা বা জাতীয় সংসদের সদস্যদের মত নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। অতএব সংবিধানের কোন ধারা, অনুচ্ছেদ বা সংশোধনী বাতিলের কোন ক্ষমতা তাদের থাকতে পারে না। যারা ভিন্ন রকম ভাবেন তাদের সঙ্গে তর্ক করবার জন্য আমরা প্রস্তুত রইলাম। তর্কটা হবে এই ধরণের ক্ষমতা বিচারপতিদের দিলে সেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় কি না! আর, আমরা তো এখন চলমান আইনি ও রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে থেকে গণতন্ত্র ব্যাপারটা আসলে কী সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।

কিন্তু সংবিধানের কোন ধারা , অনুচ্ছেদ বা সংশোধনী বাতিলের কোন ক্ষমতা বা এখতিয়ার সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ না থাকলেও বিচারপতিরা নিজেদের জন্য সংবিধানের সংশোধনী ও আইন বাতিল করবার জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তারা তাদের বৈচারিক ক্ষমতা বা এখতিয়ার প্রয়োগ করছেন সেই জায়গা হচ্ছে সংবিধানের তথাকথিত ‘মৌলিক কাঠামো’ (Basic Structure) বা ‘মৌলিক বৈশিষ্ট্য’ (Basic Feature) রক্ষা করবার জায়গা। সংবিধানে আদৌ উল্লেখ না থাকলেও দাবি করা হয়, সংবিধানের কিছু ‘মৌলিক কাঠামো’ বা ‘মৌলিক বৈশিষ্ট্য’ আছে যা জাতীয় সংসদ লংঘন করতে পারে না। বিচারপতিদের এক দল মনে করে জাতীয় সংসদ যদি এই মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ করে সংবিধানে কোন সংশোধনী আনে তাহলে আদালত তা বাতিল ঘোষনা করবার ক্ষমতা রাখে। গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার ছাড়া জাতীয় সংসদের যেকোন আইন প্রণয়ন করবার এখতিয়ার থাকে। থাকাটাই গণতন্ত্র। সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা কাঠামোর ধারণা মূলত জাতীয় সংসদের ক্ষমতাকে খর্ব করে। কারণ এই অজুহাতে বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের সংশোধনী বা আইন বাতিল করতে পারে বলে দাবি করে। আর জাতীয় সংসদ যেহেতু জনগণ দ্বারা নির্বাচিত, সেই কারণে জাতীয় সংসদের ক্ষমতা খর্ব করা মানে জনগণের ক্ষমতাকেও খর্ব করা। কার্যত এর দ্বারা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকেই নাকচ করা হয়। অন্য দিক থেকে আবার আগেই বলেছি, জনগণের নাগরিক ও মৌলিক অধিকার লংঘনের এখতিয়ার বা ক্ষমতা জাতীয় সংসদেরও থাকে না। থাকতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সেই অধিকার জাতীয় সংসদের ঠিকই আছে ।যদি কোন সংবিধানে সেটা থাকে তবে সেটা গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে জনগণের গণতান্ত্রিক কর্তব্য হচ্ছে সেই রাষ্ট্র উৎখাত করা ও গণতন্ত্র কায়েম করা।

সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো গণতন্ত্রের দিক থেকে একটি বিপজ্জনক ধারণা

কেন গণতন্ত্রে জাতীয় সংসদকে জনগণের মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করবার ক্ষমতা দেওয়া হয় না - সেই দিকটা আইনের দিক থেকে বোঝা খুবই সহজ। জাতীয় সংসদকে জনগণই নির্বাচিত করেছে। অতএব যারা তাদের নির্বাচিত করেছে তাদের অধিকার ও ক্ষমতা জাতীয় সংসদ কোন অবস্থাতেই খর্ব করতে পারে না। নাগরিকদের যে মৌলিক বা গাঠনিক ক্ষমতার (constitutive power) ওপর রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং একই সঙ্গে যে ক্ষমতা জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নী ক্ষমতার (legislative power) ভিত্তি -- জনগণের সেই ক্ষমতা খর্ব করার মানে যে ডালে কেউ বসা সেই ডাল কেটে দেওয়ার মতো ব্যাপার। এই সহজ ব্যাপার বোঝার জন্য পণ্ডিত হবার দরকার নাই।

অন্যদিকে, সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও কাঠামো গণতন্ত্রের দিক থেকে একটি বিপজ্জনক ধারণা। এই ধারণার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদের বিপরীতে একটি আলাদা ক্ষমতা-বলয় তৈরি করে। যার সঙ্গে জনগণের কোন সম্পর্ক নাই। এই ধরণের ধারণার পক্ষের বিচারপতিরা দাবি করেন জাতীয় সংসদে কোন সংশোধনী পাস হলেও সেই সংশোধনী যদি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে তারা আদালতে রায় দিয়ে তা বাতিল করতে পারবেন।

কী সেই মৌলিক কাঠামো বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য? কে তা নির্ধারণ করবে? বিচারপতিদের দাবি, এই ‘মৌলিক কাঠামো’ বা ‘মৌলিক বৈশিষ্ট্য’ নামক মিস্টিরিয়াস জিনিসটা আসলে কী, সেটাও ঠিক করবেন বিচারপতিরাই। এই কাঠামো বা বৈশিষ্ট্যটা কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একেক জন বিচারক একেক রকম তালিকা দিয়ে থাকেন। বলা বাহুল্য বিচারপতিদের মধ্যে অবশ্যই ব্যতিক্রম আছেন। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য-সংক্রান্ত ধারণা বিচারপতিদের কাছেও বিতর্কিত বিষয়। অনেকেই এই ধারণার বিরোধী। এই ধারণার সঙ্গে গণতন্ত্রের মৌলিক বিরোধ রয়েছে, সে বিষয়ে অনেকেই সজ্ঞান।

সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সংসদের যা খুশি আইন পাশ করার ক্ষমতা!

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ কার্যত যা খুশি তাই আইন করতে পারে। এই ক্ষমতা নিছকই আইন প্রণয়নী (legislative) ক্ষমতা নয়, একই সঙ্গে সাংবিধানিক (constitutive) ক্ষমতা। সংসদ নির্বাচনের অর্থ গৃহীত সংবিধানের অধীনে থেকে আইন প্রণয়নী ক্ষমতা কার থাকবে এমন সদস্যদের নির্বাচন। এটা কোনভাবেই খোদ সংবিধান রচনার ক্ষমতা থাকে এমন প্রতিনিধি সদস্য নির্বাচন নয়। এই দুই ক্ষমতা ধারণা হিসাবে সম্পুর্ণ আলাদা। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ১৪২ ধারার কারনে এই দুই ধরণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছে।

সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও (ক) সংসদের আইন দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে”। কি করে সেটা করা হবে সে সম্পর্কে কিছু পদ্ধতিগত শর্ত রয়েছে। তবে এই অনুচ্ছেদের গণবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী দিক হচ্ছে সংসদ দুই তৃতীয়াংশ ভোটে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক বিরোধী আইন পাশ করতে পারবে। অসম্পূর্, সীমিত শর্তযুক্ত হলেও এই অধিকার সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শি্রোনামে সন্নিবেশিত রয়েছে। বলা হয়েহে ১৪২(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোন সংশধনের ক্ষেত্রে ২৬ অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না’। অথচ সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদের হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করবার একমাত্র কবচ বা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। সেখানে বলা হয়ে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে “অসমঞ্জস সকল প্রচলি আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে”।

এই ধরনের অনুচ্ছেদ আদৌ নাগরিকদের অধিকার ও গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না সেই তর্কে না গিয়ে বিচারপতিরা নির্বাচিত জাতীয় সংসদের বিপরীতে নিজেদের জন্য ক্ষমতার একটি পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে চান। সে জন্যই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা মৌলিক বৈশিষ্ট্য নামক ধারণার উৎপত্তি বা আমদানি ঘটেছে। আসলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য নামক ধারণা ভারতের আদালতের দেখাদেখি বাংলাদেশের বিচারপতিদের একটি আবিষ্কার যা নিয়ে আলাদা ভাবে আলোচনা করা দরকার। তবে আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য এই মুহূর্তে সেই কাজ বিশেষ জরুরি নয়। বরং এই ধরণের ধারণার মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অগণতান্ত্রিক ও গণবিরোধী ধ্যানধারণা কিভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটাই বেশি বোঝা দরকার।

কিভাবে সেটা আমরা বুঝব? বিচারপতিরা যেখানে সংবিধানের এইসব গুপ্ত কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার ও রক্ষা করতে ব্যস্ত সেখানে জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তারা সমান অমনোযোগী ও উদাসীন। অথচ এটাই বিচার বিভাগের -- বিশেষত উচ্চ আদালতের প্রধান কাজ। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অন্যায় ক্ষমতা প্রয়োগ বা জাতীয় সংসদের হাতে নাগরিক ও মানবাধিকার বিরোধী আইন প্রণয়নের বিপদ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করা বিচার বিভাগের প্রধান দায়িত্ব। অথচ নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কোন উদ্বিগ্নতা নাই বললেই চলে। এই উদাসীনতা এখন চরম ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনার এই আমলে আমরা দেখেছি বিচারপতিরা নাগরিকদের জামিন পাওয়া ন্যায়সঙ্গত হলেও জামিন দেন না। নির্বাহী বিভাগের ইঙ্গিতের দিকে চেয়ে থাকেন বলে যে কারনে অভিযোগ ওঠে। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন অভিযুক্ত নাগরিককে রিমান্ডে নিতে চাইলে বিচারপতিরা তাদের নির্যাতন করা হবে জেনেও রিমান্ড দিয়ে থাকেন। এমনকি রিমান্ডে নির্যাতিত হয়ে তার দাগ বা চিহ্ন নিয়ে আদালতে ফিরে আসলেও বিচারক তা দেখেন না। এভাবে বিচার ব্যবস্থা চলত পারে না। এমনকি অভিযুক্ত আদালতের কাছে প্রমাণ দেখিয়ে অভিযোগ করলেও বিচারক নির্বাক থাকেন, আমলে নেন না। এছাড়া রিমান্ডে নির্যাতন করে অভিযুক্তের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় মানবাধিকার বিরোধী ও বেআইনি হলেও বিচারপতিরা রিমান্ড দিয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে আদালত অবমাননার দোহাই দিয়ে তারা নাগরিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করছেন না। অথচ, অন্য দিকে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন হওয়ার অজুহাতে জাতীয় সংসদে গৃহীত বিভিন্ন সংশোধনী বাতিল করে দিচ্ছেন। এ এক পরাবাস্তব পরিস্থিতি!

সংবিধানে ‘মৌলিক কাঠামো’ বা ‘মৌলিক বৈশিষ্ট্য’ নামক কোন অনুচ্ছেদ নাই, কিন্তু সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শিরোনামে একটি সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিভাগ রয়েছে। না থাকলেও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্যের পক্ষে বিচার বিভাগের দিক থেকে একটা ইতিবাচক তর্ক থাকতেই পারে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে তর্কের ক্ষেত্রে অনেকে সেটা দাবি করেছেন। বাংলাদেশের বিতর্কেও শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। কিন্তু বাংলাদেশে মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত তর্ক শেষাবধি বিচারপতিদের স্বার্থ ও জাতীয় সংসদের বিপরীতে বিচার বিভাগের ক্ষমতার অধিক কিছু হয়ে ওঠে নি। তা ছাড়া যেখানে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষাই বিচার বিভাগের মুখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য, সেই অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট না হয়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য রক্ষার চিন্তা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেবার মতো ব্যাপার। একে সাংবিধানিক বিতর্কের প্রধান বিষয়ে পরিণত করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক ধ্যানধারণাকে অপরিচ্ছন্ন করে তোলা হয়েছে।

রাজনীতি ও আইনের সম্পর্ক

আমাদের সমাজ রাজনীতি ও আইনের সম্পর্ক বোঝার ক্ষেত্রে এখনও খুবই অপরিণত। দুইয়ের সম্পর্ক এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের জন্য অপরিণত ও অপরিচ্ছন্ন চিন্তা বড় একটি বাধা। অধিকাংশেরই ধারণা আইন মাত্রই অতি পবিত্র জিনিস, একে যে কোন অবস্থাতেই মানতে হবে এবং বিচারপতি মাত্রই ফেরেশতার সমতুল্য। কিন্তু আইন তো কালো আইনও হতে পারে আর বিচারপতিও বদ হতে পারেন। বিচারপতি কেউই ফেরেশতা নন, তারা আমাদের মতোই ভালমন্দে মানুষ। বিচারপতিদের ওপর নির্বিচার আস্থার কারনে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে বিচারপতিদেরই সবার আগে প্রধান উপদেষ্টা বানাবার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেন অন্য কোন পেশার মানুষ এই ভূমিকা পালন করবার যোগ্য নয়। উল্টা দিকে দেখি রাজনীতি মাত্রই নোংরা ব্যাপার গণ্য করার প্রবল মানসিকতা। যেন, রাজনীতিবিদরা শয়তানের খালাতো ভাই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ সন্দেহ নাই, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজনীতি, রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামই প্রধান ভূমিক পালন করেছে, আর সেই ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে রাজনীতিই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।

জাতীয় সংসদের সদস্যদের জনগণ সরাসরিই নির্বাচিত করে, যাদের প্রধান দায়িত্ব সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়ণ করা। সেই দিক থেকে জনগণের সঙ্গে আইন তৈরির সম্পর্ক সরাসরি। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে আমরা নেহায়েতই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া হিশাবে দেখি, জনগণের পক্ষে আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা চর্চা আকারে দেখি না। আমাদের আলোচনার জন্য যে দিকট গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল বিচার বিভাগ জনগণের পক্ষে এই আইন প্রণয়নী ক্ষমতার অধীন বা সোজা কথায় আইন প্রণয়নের ক্ষমতার দিক থেকে বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদের অধীন। বিচার বিভাগের নিজের কোন আইন প্রণয়ণের ক্ষমতা নাই, যদিও আইন ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা রয়েছে । অন্যদিকে জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে যে-রাজনৈতিক সম্পর্ক  জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নী ক্ষমতা তৈরী করে ভাবে বিচার বিভাগ সেই রাজনৈতিক সম্পর্কেরও অধীন। রাজনীতি ও আইন তৈরির এই সম্পর্কের জায়গা অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে।

বিচার বিভাগের তথাকথিত ‘স্বাধীনতা’-র ধারণাও চরম বিভ্রান্তি তৈরি করে। দেখা যায় গণমাধ্যমে এই ধরণের ধারণা নির্বিচারে প্রচার করে। অনেকের ধারণা বিচার বিভাগকে স্বাধীন করে দিলেই বুঝি সমাজ ও রাজনীতির সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। বিচার বিভাগ সংবিধান ও আইনের অধীন, এই দিকটা আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু যে দিকটা আমরা আলোচনা করছি সেই দিকটি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা নাই বললেই চলে।

এটা ঠিক যে বৈচারিক দায়িত্ব নির্বাহ করবার দিক থেকে বিচার বিভাগকে সরকার ও জাতীয় সংসদ থেকে আলাদা বা ‘পৃথক’ ভাবে দায়িত্ব পালন করা দরকার। অতএব তাদের আলাদা ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরী। কিন্তু সেটা বিচার বিভাগের ‘স্বাধীনতা’ নয়। বিচার বিভাগ শুধু সংবিধানের অধীন তাই নয়, এমনকি একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত করবার প্রত্যক্ষ সম্পর্কের কারনে চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও অধীনস্থ। ‘স্বাধীন’ বিচারবিভাগের ধারণা গণতন্ত্রের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ইংরাজিতে Independent Judiciary-র অনুবাদ ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগ নয়। এর উপযুক্ত মানে হছে রাষ্ট্রের অন্য কোন অঙ্গের ওপর বিচার বিভাগ dependent বা নির্ভরশীল থাকবে না। এই কথাগুলো বলতে বাধ্য হচ্ছি এ কারনে যে আমার আশংকা আমাদের সমাজে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’ নামক অগণতান্ত্রিক ধারণার আধিপত্যের কারনে অনেকে ভাবেন বিচার বিভাগ বুঝি যা খুশি রায় দিতে পারে। আর তা মানতে নাগরিকরা বাধ্য। আবার অনেকে মনে করতে পারেন বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে বিচারপতিরাও বুঝি স্বাধীন। বিচারপতির ব্যক্তিগত ‘মত’ সেই কারনে আইন হিশাবে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। একই কারনে গণমাধ্যমে দেখছি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান ত্রয়োদশ সংশোধনীর পূর্ণ রায়ের মধ্যে অনুসন্ধানের নিস্ফল প্রয়াস চলছে। অন্যদিকে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দিক থেকে এই রায় নাকচ করে দেবার কারনে একটা হাস্যকর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়েছে।

মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকারের অলংঘনীয়তা

রাজনীতি ও আইনের সম্পর্কের অর্থ এই নয় যে রাজনৈতিক দলগুলো যা খুশি আইন তৈরি করতে পারে। যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিশাবে অগণতান্ত্রিক বলে ১৪২ অনুচ্ছেদে কার্যত এই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিশাব গঠিত হলে এই ধরনের অনুচ্ছেদ আপনাতেই বাতিল হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের মূল জায়গা হচ্ছে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার। এই অধিকার লংঘন করবার ক্ষমতা গণতন্ত্রে জনগণ কাউকেই দেয় না। দিতে পারে না। রাজনৈতিক দলকেও নয়। গণতন্ত্র এই ক্ষমতা কারুরই থাকতে পারে না। যে কারনে একজন নাগরিকের এই অধিকারের সীমা ততোটুকুই যতোটুকু অন্যের অধিলার লংঘিত না হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই অধিকার রক্ষা করতে গিয়েই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ‘গঠিত’ হয়ে ওঠে। এছাড়া অন্য যেকোন বিষয়ে জনগণের ইচ্ছা আকাংখা রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত হয়ে উঠলে, অর্থাৎ একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত গড়ে উঠলে জাতীয় সংসদে তার প্রভাব পড়তেই পারে। তার ভিত্তিতে একটা লিখিত রূপ জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত হতে পারে ও গৃহীত হলে সেটা আইনের শক্তি লাভ করে বা আইন হয়ে ওঠে। রাজনীতি সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মত তৈরি করে। আর সেটা করবার মধ্য দিয়েই আইনের ন্যায্যতা ও কার্যকারিতা কায়েম হয়। মূল কথা হোল আইন অনুসরণ করে রাজনৈতিক কনসেনসাস বা সম্মতির জন্ম হয় না। রাজনৈতিক সত্যই আইনী রূপ পরিগ্রহণ করে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মানুষ স্বাধীন ও সার্বভৌম, ব্যক্তির মর্যাদা অলংঘনীয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সম্মতি ছাড়া কেউ শাসক হবে না –এইসকল ধারণা গণতন্ত্রের মূল কথা। দর্শন অবশ্য এই সকল ধারণার সমালোচনা করে, একে শ্বাশ্বত সত্য হিশাবে মানে না। কিন্তু সমাজ বিকাশের একটি স্তরে মানুষ নিজেকে এই ভাবেই ভাবতে শেখে। সমাজের চিন্তা চেতনের স্তরে এই চিন্তা অলংঘনীয় গণ্য হলে এই ধারণাই রাজনৈতিক সত্যের ভুমিকা পালন করে। এই রাজনৈতিক সত্যই তখন দেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। রাজনীতি ও আইনের এই সম্পর্কের দিকটি এভাবে অনুধাবন করলে আমার কথা বুঝতে সুবিধা হবে। একই সঙ্গে দর্শনের সঙ্গে রাজনীতির পার্থক্যও আমরা বুঝতে শিখব। বুঝতে পারব গণতন্ত্র কায়েম একটি সমাজের জন্য বিশেষ অবস্থায় বা স্তরে দরকারি হতে পারে কিন্তু চরম লক্ষ্য হতে পারে না । রাজনৈতিক গণতন্ত্রই রাষ্ট্রের চরম আদর্শ নয়।

আদালত জগতে একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ প্রুডেন্স বা কাণ্ডজ্ঞান। এই দিক থেকে ব্যক্তি হিশাবে বিচারকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিজের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বিচারককে যাচাই করতে হয় তার সামনে বিচারের জন্য হাজির করা কো্ন্‌ বিতর্ক রাজনৈতিক আর কোনটি সাংবিধানিক বা আইনী। আদালতের এখতিয়ার আর রাজনীতির পরিমণ্ডলের পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন না হলে একজন বিচারক একটি দেশে ভয়াবহ বিপর্যয় ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারেন। রাজনৈতিক-সামাজিক বিতর্ক বা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক বিতর্ক নিরসিত হয়। আদালতের রায় দিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সমাধান করা যায় না।

বিচারকের কাণ্ডজ্ঞান ধরা পড়ে রাজনৈতিক বিতর্ক আদালতের রায় দিয়ে সমাধানের চেষ্টা না করার মধ্যে। সামাজিক-রাজনৈতিক কিম্বা কোন ঐতিহাসিক বিতর্ক বিচারকের আমলে নেবার অযোগ্য ঘোষণা করা এবং তাকে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ফেরত পাঠানোর মধ্যেই বিচারকের প্রজ্ঞা ধরা পড়ে। বিচারকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা একটি সমাজের জন্য অভিশাপ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

জাতীয় সংসদে গৃহীত সাংবিধানিক সংশোধনী বাতিল করবার এখতিয়ার বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আদালতের আছে কিনা এই তর্ক এড়াবার যে আর কোন সুযোগ নাই এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এত কথা বলতে বাধ্য হয়েছি। শুধু যে বাংলাদেশের সংবিধানের চরিত্র বোঝার জন্য এই তর্কের মীমাংসা কাজে লাগে তা নয়, আগামি দিনে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে যে সকল বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে তার উপাদানও আমরা ওপরের পর্যালোচনা থেকে শনাক্ত করতে পারি। বাংলাদেশের আদালত সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যের অজুহাত তুলে দাবি করছে জাতীয় সংসদে গৃহীত সাংবিধানিক সংশোধনী বাতিল করবার এখতিয়ার তাদের আছে। আমরা তা মনে করি না। সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাবে এই ধরণের কোন মৌলিক বৈশিষ্ট্য বা কাঠামোর কথা নাই।

গণতন্ত্রের দিকে থেকে মূল বিষয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য নয়, বরং মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার। সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাবে ‘মৌলিক অধিকার’ শিরোনামে তা উল্লেখ করা থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানেও আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক না হবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এই অধিকার হরণের এখতিয়ার সংবিধানের ১৪২ অনুছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদকে দেওয়া রয়েছে। অথচ গণতন্ত্রে মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার অলংঘনীয়, এই অধিকার হরণ করবার কোন এখতিয়ার যেমন জাতীয় সংসদের নাই, নির্বাহি বিভাগেরও নাই। তেমনি আদালতেরও নাই। এই অলংঘনীয় অধিকার রক্ষা করার মধ্য দিয়েই আদালত সংবিধান রক্ষা করে। এই অধিকার লংঘিত হলে বিচারক তার শপথ ভঙ্গ করেন। তাই আদালতের মুখ্য কাজ হচ্ছে নাগরিকদের এই অধিকার লংঘিত হলে তা রক্ষা করা। অর্থাৎ সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করলে আদালত অবশ্যই তা বাতিল করতে পারে। এটাও আমাদের বুঝতে হবে যে গণতন্ত্র কায়েম করা ও কায়েম থাকার মানে হচ্ছে আদালতের এই ক্ষমতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠা এবং আদালতের এই ক্ষমতা আছে তা সবসময় দৃশ্যমান থাকা। মৌলিক নাগরিক ও মানবিক অধিকার লংঘনের অধিকার রাজনৈতিক দলেরও নাই বা থাকে না। তারা রাজনীতির মাঠে থাকুক, কিম্বা সংসদে। আদালতই জনগণের এই অধিকার রক্ষার দায়িত্বে বিশেষ ভাবে নিযুক্ত থাকে। আর ঠিক এই ক্ষমতার মধ্য দিয়েই নির্বাচিত না হয়েও জনগণের সঙ্গে আদালত সরাসরি ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কায়েম রাখে। নির্বাচিত না হয়ে গণশক্তির বাহন হয়ে ওঠে। উঠতে পারে। আদালতের শক্তির জায়গাও নাগরিকদের অধিকার রক্ষার মাত্রা দিয়ে নির্ধারিত হয়। এই দিক থেকে গণতন্ত্রে আদালত জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের চেয়েও শক্তিশালী।

অনেকে দাবি করেন সংবিধানকে ব্যাখ্যা করা এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে নতুন আইন তৈরি বা নতুন আইন জন্ম দেবার এখতিয়ার আদালতের আছে। এই দাবি মেনে নিলেও পরিষ্কার যে আদালতের এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ও  সুনির্দিষ্ট। আদালতকে তখন প্রমাণ করতে হয় যে-ব্যাখ্যা আদালত দিচ্ছে সেই ব্যাখ্যা সংবিধান বা আইন প্রণেতা যে উদ্দেশ্যে সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করেছেন সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু সংবিধানে যার উল্লেখ নাই তা রক্ষা করবার অজুহাত তুলে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের বাইরে আদালতের বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা স্বীকার করার অর্থ হচ্ছে অনির্বাচিত ব্যাক্তির হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তুলে দেওয়া, যারা জনগণের প্রতিনিধি নয়।

আসলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক ভাবেই তার মীমাংসা হতে হবে। সেই মীমাংসা সম্পন্ন হলে জাতীয় সংসদ আজ যা বাতিল করেছে কাল তা আবার অনায়াসেই ফিরিয়ে আনতে পারে। জাতীয় সংসদ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করতে পারে, তাহলে তা আবার ফিরিয়েও আনতে পারে। কিম্বা বিবদমান দুই পক্ষ অন্য কোনো সমঝোতা করতে পারে। আর, ক্ষমতাবান শ্রেণী ও শক্তি যদি নির্বাচন চায় তাহলে এই তর্কের মীমাংসা তারা অনায়াসেই নিজেরা করতে পারে। আদালতের দরকার পড়ে না।। কিন্তু রাজনীতিতে আদালতকে টেনে আনার অর্থ হছে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করা। শেখ হাসিনা এই কাজটিই খুব ভাল ভাবে করেছেন। রাজনীতিতে আদালতের কোন ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। আইন ও রাজনীতির পারস্পরিক সীমা সম্পর্কে হুঁশ না থাকলে রাজনীতি ও আদালত উভয়েরই ক্ষতি।

অতএব সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় বাংলায় লিখেছেন নাকি ইংরাজিতে লিখেছেন, তিন পাতা লিখেছেন নাকি ৩৪২ পাতা লিখেছেন সেই সব তর্ক অর্থহীন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে কী সব যুক্তি প্রমাণ হাজির করেছেন, সেই সব যুক্তি শক্তিশালী, অর্বাচীন ও নাকি স্ববিরোধী তাতেও কিছু আসে যায় না। বরং জনগণের কর্তব্য হচ্ছে আদালতকে রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসার জন্য দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবার এই নজির সৃষ্টির নিন্দা করা।

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তার সিদ্ধান্ত বিচারপতিরা এর আগে দেন নি, এখনো তাদের দেবার এখতিয়ার নাই। ক্ষমতাবানদের সকল পক্ষকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করাতে হলে শেখ হাসিনাকে অচিরেই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সেই ক্ষেত্রে বিশাল ও ঢাউস ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়ের কোন ভূমিকা থাকবে কি না সন্দেহ।

১৯ আশ্বিন ১৪১৯। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২। শ্যামলী।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।